খালেদা জিয়ার পথের কাঁটা by শাহরিয়ার কবির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর সম্পর্কে তাঁকে উদ্দেশ করে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, যদি কিছু আনতে না পারেন তাহলে.... আপনার রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দেব। ১ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সম্মেলনে এ কথা বলেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।


পরদিন এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি দেশের মানুষের অগ্রযাত্রার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল। এখন সেই কাঁটাই পরিষ্কার করছি।
প্রতিপরে পথ কন্টকিত করা বিএনপির রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা দলটির জন্মকাল থেকে আমরা ল্য করছি। ১৯৭৫-এ স্বাধীন বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর মতায় এসে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টে বসেই বিএনপি গঠন করেছিলেন। মেজর জেনারেলের উর্দি পরেই জিয়া বেয়নেটের খোঁচায় '৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় চেতনা মুছে ফেলেছেন, যা অর্জিত হয়েছিল তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা লাঞ্ছিতকরণ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে '৭২-এর ধর্মনিরপে গণতান্ত্রিক সংবিধানকে পাকিস্তানপ্রেমী জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের আদলে একটি কদর্য সাম্প্রদায়িক সংবিধানে রূপান্তর করেছেন উপরে 'বিসমিল্লাহ...' এবং ভেতরে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি' সংযোজন করে। এর পাশাপাশি '৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দালাল ও ঘাতকদের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার যাত্রাপথে কাঁটা বিছিয়ে জিয়া সুস্থ রাজনীতির পথেও কাঁটা বিছিয়েছেন 'মানি ইজ নো প্রব্লেম', 'আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ান' ইত্যাদি ঘোষণা করে। মতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জিয়ার এই অবস্থানই প্রমাণ করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। '৭১-এ খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষীসহ পাকি-মার্কিনপ্রেমী অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, যা তারা চরিতার্থ করেছে '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। নিজের সিংহাসন নিষ্কন্টক করার জন্য জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর দুই হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছেন, যে তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক কর্নেল তাহেরের মতো যুদ্ধাহত অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।
'৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রু পাকিস্তানকে পরম মিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র ভারতকে চরম শত্রু হিসেবে গণ্য করার রাজনীতি বিএনপি শুরু করেছে জেনারেল জিয়ার জমানা থেকেই। পাঠ্যপুস্তক ও সরকারী প্রচার মাধ্যম থেকে জিয়ার আমলেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস মুছে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজের 'পাকিস্তানীকরণ' এবং মওলানা মওদুদীর দর্শন অনুযায়ী 'ইসলামীকরণ'ও শুরু হয়েছে '৭৫ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়ার যোগ্য সহধর্মিণী খালেদা জিয়া প্রথমবার '৯১ সালে মতায় এসেছেন '৭১-এর ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতের সহযোগিতায় এবং দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে মতায় এসেছেন জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট করে। যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গী মৌলবাদীদের গডফাদার নিজামী-আমিনীদের সঙ্গে জোট বেঁধে মতায় এসে খালেদা জিয়া প্রগতির সকল পথেই কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি আমরা যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আন্দোলন করছিলাম, পাকিস্তানী প্রভুদের তুষ্ট করার জন্য আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে কারাগারে বন্দী করে যাবতীয় নির্যাতন করতে সামান্যতম কার্পণ্য করেনি খালেদা-নিজামীদের জোট সরকার। ২০০১ সালে মতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মনিরপে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকমর্ীদের হত্যা, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি যেভাবে জঙ্গী মৌলবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে তার মাসুল আজও গুনতে হচ্ছে।
গত এক বছরে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী মৌলবাদী নেতারা অকপটে প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের 'আইএসআই'-এর অর্থ সাহায্যে তারা কীভাবে বাংলাদেশের জঙ্গীদের সামরিক প্রশিণ প্রদান করেছে, কীভাবে রাজনৈতিক দলের জনসভা, আদালত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ পীর-আউলিয়াদের মাজারে গ্রেনেড-বোমা হামলা করেছে এবং কীভাবে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা তাদের মদদ দিয়েছেন। খালেদা-নিজামীদের জমানায় যাবতীয় গ্রেনেড বোমা হামলা ও হত্যার দায় জঙ্গী মৌলবাদীরা কবুল করলেও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরীতি মিত্র জামায়াতপ্রধান নিজামীসহ জোটের শীর্ষ নেতারা তখন বলেছেন, এসব গ্রেনেড ও বোমা হামলা করেছে আওয়ামী লীগ ও ভারত। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে হরকাত-উল-জিহাদের জঙ্গীরা ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। এর কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই গ্রেফতার করা হয়েছে আমাকে, আমার বন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং আওয়ামী লীগের কয়েক শীর্ষ নেতাকে। মামুন ও আমাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে 'বোমা হামলা আওয়ামী লীগ ও ভারত করেছে'_ এটা লিখে দেয়ার জন্য। আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ উচ্চতর আদালতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা প্রমাণিত হলেও এ নিয়ে খালেদা-নিজামীরা বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করেননি। 'হরকাত-উল-জিহাদ', 'জামাতুল মুজাহিদীন' কিংবা 'লস্কর-তৈয়বা'র মতো জঙ্গী সংগঠন যতই বলুক, তারা পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই'-এর নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী যাবতীয় গ্রেনেড-বোমা হামলা করেছে; খালেদা-নিজামীদের এক রা_ এসব নাকি ভারতের কাজ। তাদের কথা শুনে মনে হয় ভারতের নির্দেশেই পাকিস্তানের আইএসআই বাংলাদেশে তাদের এজেন্টদের দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে!
ভারত থেকে খালি হাতে ফিরলে শেখ হাসিনার পথ কন্টকাকীর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। এ কাজ তো তিনি এবং তাঁর প্রধান দোসর নিজামীরা করছেন গত এক বছর ধরে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গী মৌলবাদ নিমর্ূল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে তখন থেকেই খালেদা-নিজামীরা সরকারের চলার পথে কাঁটা বিছানো শুরু করেছেন। প্রথমে খালেদা-নিজামীরা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, আবার কখনও বলছেন এই বিচার নাকি ইসলামবিরোধী। নিজামীদের মতো খালেদা জিয়াও মনে করেন পাকিস্তান ও জামায়াতের সমালোচনা মানে ইসলামবিরোধিতা এবং এ কারণে শেখ হাসিনা ইসলামের দুশমন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে খালেদা জিয়াসহ তাঁর অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ ফেঁসে যেতে পারেন। নিজামীদের যদি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ট্রাইবু্যনালে দাঁড় করানো হয় তারা নিশ্চয় একা ফাঁসিতে ঝুলতে চাইবে না। '৭১-এ খালেদা জিয়া কেন ভারতে না গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী জেনারেলদের আতিথেয়তা উপভোগ করেছেন_ এটা জামায়াতই বলবে। কারণ জামায়াতের মতো খালেদা জিয়াও '৭১-এ পাকিস্তানকে পরম মিত্র এবং ভারতকে পাকিস্তান ও ইসলামের চরম শত্রু মনে করে রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের সঙ্গী হওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানী জেনারেলদের আপ্যায়ন গ্রহণ করেছেন আনন্দের সঙ্গে। তখন থেকে তিনি পাকিস্তানকে ফুল আর ভারতকে কাঁটা মনে করেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম জমানায় খালেদা জিয়া '৭১-এ ঢাকায় অবস্থানকারী এক পাকি জেনারেলের মৃতু্যতে সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে শোকবার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিলেন।
এহেন খালেদা জিয়া ভারতকে এখনও চরম শত্রু মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের দুনর্ীতির মামলা ধামাচাপা দেয়ার জন্য খালেদা জিয়া গত এক বছরে কম তেলেসমাতি দেখাননি। বিডিআর বিদ্রোহ দমনের জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন বিদ্রোহ চলাকালে বিডিআর সদর দফতরে গিয়ে নিহত হননি, কেন বিদ্রোহ দমনের নামে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধ বাধতে দেননি_ এ নিয়ে খালেদার ােভের অন্ত নেই। তদন্তে কেন এল না : ভারত এ বিদ্রোহের জন্য দায়ী_ এ নিয়েও তাঁর আপে কম নয়। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ইসু্য নিয়ে হালে পানি না পেয়ে কখনও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে, কখনও এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তি, কখনও ট্রানজিট এবং কখনও ভারতীয় দূতাবাসে ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার প্রতিবাদ করে বিএনপি ক্রমাগত আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে এবং যথারীতি জনগণ কতর্ৃক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার পথে কাঁটার বদলে ফুল বিছিয়ে দেবেন যদি তিনি দিল্লী থেকে ফিরে এসে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি ও কনফেডারেশনের চুক্তি করেন। জামায়াতের প্রধান নিজামী গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করলে জামায়াত শেখ হাসিনার সরকারকে সহযোগিতা করবে। খালেদাও করবেন যদি তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এখন শেখ হাসিনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে_ তিনি খালেদা জিয়ার ফুল বিছানো পথে, না কাঁটা বিছানো পথে হাঁটবেন।
৩ জানুয়ারি ২০১০

No comments

Powered by Blogger.