বাল্য বিয়ে by মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে আমরা যখন নারীর অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন প্রচেষ্টা, নীতিমালা এবং আইন তৈরি করছি ঠিক সে সময়ে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাল্যবিয়ে হচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সমাজে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে দেশে প্রচলিত আইন থাকলেও বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সীমিত। যার ফলে এর নিদারুণ বলি হতে হচ্ছে মেয়েশিশুকে।


একজন নারীর স্বাভাবিক শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের পথে অন্যতম বাধা হচ্ছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে নারীকে একটি নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এতে বাধাপ্রাপ্ত হয় তার তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা। অপরিণত বয়সে নিতে হয় সন্তান লালন-পালন এবং পরিবারের কঠিন দায়িত্ব। বাড়িয়ে দেয় অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান জন্মদানের মতো ঝুঁকি। গত ২২ এপ্রিল ২০১২ বিবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে অহনধৎধংধহ ঊঃযরৎধলধহ উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০% মেয়ে শিশু তাদের ১৫তম জন্ম দিনে পা দেয়ার আগেই বাল্যবিয়েতে আবদ্ধ হয়।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভের রেকর্ড অনুযায়ী ২০-২৪ বয়সী ৬৬% নারী ১৮ বছর বয়সের আগেই বিবাহে আবদ্ধ হয়েছেন।
১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করার মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
অর্থাৎ একুশ বছরের কম বয়সের ছেলে এবং আঠারো বছরের কম বয়সের মেয়ে অথবা উল্লিখিত বয়সের চেয়ে যে কোন একজনের বয়স কম এমন ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে হলেই তা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ৫ ধারা অনুসারে এ অপরাধের শাস্তি একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয়ই হতে পারে। বর্তমানে বয়স চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জন্ম-নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটের মতো প্রচলিত ব্যবস্থা বা ডিএনএ টেস্টের মতো আধুনিক ব্যবস্থাও রয়েছে। তারপরও বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, কাজীকে ঘুষ দিয়ে কন্যার বয়স বাড়িয়ে দেয়া, রাতের আঁধারে মেয়েকে ছেলের আত্মীয়ের বাড়িতে স্থানান্তর করে এবং চেয়ারম্যানকে অনুকূলে এনেও বাল্যবিয়ে হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯-এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বনিম্ন শাস্তি প্রদান। তাছাড়া এই আইনের ধারা ৯-এ বলা আছে যে, বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত মামলা এক বছরের মধ্যে আদালতের সামনে আনতে হবে। এতে বাল্যবিবাহে উৎসাহী ব্যক্তিরা খুব সহজেই ঠিক করে নিতে পারে যে, একবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এক বছর কোনো রকম গোপন রাখতে পারলেই আর কোনো শাস্তি হবে না।
সম্প্রতি জয়পুরহাটের তিনটি ইউনিয়নে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রশিক্ষণ-পরবর্তী মূল্যায়ন সমীক্ষা পরিচালনা শেষে দেখা যায় যে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২৫ নারীর মধ্যে ২২ জনই বাল্যবিয়েতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যার মূল কারণ হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবকে চিহ্নিত করা যায়। সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দরিদ্রতা একটি অন্যতম প্রধান কারণ যা গ্রামীণ অভিভাবকদের তাদের কন্যাদের শিশু বয়সে বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাধ্য করে। অভিভাবকরা কন্যা শিশুদের সম্পদ মনে না করে মনে করেন বোঝা। তারা মনে করেন মেয়ের পেছনে টাকা খরচ করে লাভ নেই, সুতরাং বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলেই দায়ভার কমে যায়। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। মেয়ে শিশু যে কোন সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে এই আশঙ্কায় তারা মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়াকেই নিরাপদ মনে করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন ল’ইয়ারস এ্যাসোসিয়েশনের এক তথ্য অনুযায়ী, ১০-১৮ বয়সী মেয়েদের ৯০%-এরই কোন না কোনভাবে ইভটিজিংয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যা কিশোরীদের আত্মহত্যার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী।
বিয়ের পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অল্পবয়সকে প্রাধান্য দেয়া হয়। মেয়েরা কুড়িতে বুড়িÑযে সমাজে এ ধরনের প্রবাদ রয়েছে, সেখানে বাল্যবিবাহ না থাকার কোন কারণ নেই।
অভিভাবকদের অশিক্ষা ও অসচেতনতাকেও বাল্যবিয়ের জন্য একটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা শিক্ষিত এবং সচেতন পিতা-মাতা কখনই তাদের সন্তানকে কম বয়সে বিয়ে দেবেন না। গত ৩ জুলাই, ২০১২ ইউনিসেফের বাংলাদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শিশু বিশেষজ্ঞ এ্যামি ডেলনিউভিলি (অসু উবষহবাঁরষষব) তার কর্মীদের মাঠ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, কাজীরা অভিভাবকদের সম্মতিতে মেয়েশিশুর বয়স বাড়িয়ে দিয়ে বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করছেন।
বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিয়ে রোধে অন লাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন উপাত্ত সংগ্রহের একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। যা ২০১৩ সালের জুন মাসে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে সরকার একটি প্রচারণা পরিচালনা করেন। সেখানে দেখা যায় ৯০% শিশুর জন্ম সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। দেরি করে হলেও সরকার যে জন্ম নিবন্ধনের বিষয়টির গুরুত্ব আঁচ করতে পেরেছে সেটাও কম নয়। তবে সফলতা নির্ভর করবে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও জনগণের আগ্রহের ওপর।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিয়ের ক্ষেত্রে নিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কাজীরা এই শর্তকে পূরণ করছেন। তবে বয়সের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে।
অল্প বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুক কম দিতে হবে এমন ধারণাও অনেকের মাঝে বিদ্যমান। যার ফল হচ্ছে বাল্যবিয়ে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সাল থেকে ফিমেইল সেকেন্ডারি স্কুল এ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্প চালু করে। উদ্দেশ্য ছিল কন্যাশিশুদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং বাল্যবিয়ে রোধ। কিন্তু প্রোগ্রামটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিযোগ যেমনÑনিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ না করে টাকা নেয়া, স্কুল কমিটি কর্তৃক টাকা আত্মসাৎ করা ইত্যাদি। [সূত্রÑআইআরআইএন (হিউমেনিটারিয়ান নিউজ এ্যান্ড এ্যানালিসিস) ৩ জুলাই, ২০১২]। সরকারের এই প্রোগ্রামটি বাল্যবিয়ে রোধে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তার জন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক উপায় অবলম্বন অতি জরুরী। শুধু আইন করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সকল শ্রেণীর সচেতন ব্যক্তিদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সবার সহযোগিতা এবং সমন্বিত কার্যক্রমই পারে বাল্যবিয়ে থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে।

No comments

Powered by Blogger.