প্রসঙ্গ ইসলাম- সিয়াম যুগে যুগে নানাভাবে by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

সিয়াম ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য ফেব্রুয়ারি মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর মধ্য শা’বানে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সিয়ামের যে বিধান দেন তাতে বলা হয়েছে : ওহে! তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের প্রতি সিয়াম বিধান দেয়া হলো যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)।


এখানে তোমাদের পূর্র্ববর্তীদের দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামপূর্ব যামানায় সিয়াম ছিল। সিয়ামকে আমরা সাধারণত রোজা বলি। আসলে তদানীন্তন পারস্যে যুরুস্ত্রুদের মধ্যে যে সিয়াম পালন রীতি প্রচলিত ছিল তার নাম ছিল রোযা। ইসলাম পারস্যে গেলে সেখানে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা ইসলামের সালাতকে নামায হিসেবে গ্রহণ করে, সিয়ামকে গ্রহণ করে রোযা হিসেবে। খোদা শব্দটিও পারসিক। এর অর্থ স্বয়ংভু। অথচ কোনভাবে কোনদিকে নজর না দিয়ে এসব শব্দ ব্যবহার করে আমরা মূল শব্দ থেকে দূরে চলে যাই। আমরা যে রমজান বা রমযান ব্যবহার করি, এটাও আরবী রমাদানের ফারসী উচ্চারণ মাত্র। সে সব যাক।
সিয়াম মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে। আদিপিতা আদম আলায়হিস্ সালাম এবং আদিমাতা হাওয়া আলায়হাস সালাম পৃথিবীতে অবতরণ করে দীর্ঘকাল পানাহার এবং দু’জন দুই স্থানে অবস্থান করার কারণে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একান্ত মিলনেরও কোন সুযোগ পাননি, তাঁরা সর্বক্ষণ তওবা-ইসতিগফারে নিমগ্ন ছিলেন। সিয়ামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁরাই স্থাপন করেন। সকল প্রকারের পানাহার, কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম।
আল্লাহর নবী হযরত নূহ আলায়হিস সালাম মহাপ্লাবন থেকে উদ্ধারের জন্য কিস্তি নির্মাণকালে এবং কিস্তিতে জোড়ায় জোড়ায় পশু, পাখি এবং গাছপালা, তৃণ-উদ্ভিদের চারা, ফল-ফসল তোলারকালে স্বভাবতই পানাহার করেননি।
সিয়াম বিধান দৈহিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য এক অনন্য বিধান। যুগে যুগে আল্লাহর নবী-রসূলগণ সিয়াম বিধান বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নানান সংখ্যায় প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ, হযরত মূসা কলীমুল্লাহ, হযরত দাউদ খালীফাতুল্লাহ, হযরত ঈসা রূহুল্লাহ প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কেরাম বিভিন্ন উপলক্ষে সিয়াম রেখেছেন।
হযরত মূসা আলায়হিস সালাম ফেরাউনের কারাগার থেকে হাজার হাজার বনী ইসরাঈলকে মুক্ত করে এবং তাঁর পবিত্র লাঠির আঘাতে উত্তাল লোহিত সাগরের বুকে রাস্তা বের করে ওপারে আল্লাহর রহমতে পাড়ি দিতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সেই রাস্তা ধরে হযরত মূসা আলায়হিস সালামকে ধরবার জন্য সসৈন্যে ফেরাউন অগ্রসর হলে দরিয়া তাদেরকে গ্রাস করে নেয়। হযরত মূসা আলায়হিস সালাম এই মুক্তির শোকরের নিদর্শনস্বরূপ মুক্তির সেই দিনটিতে অর্থাৎ ১০ মুহররম আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করতেন। আমাদের প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাসসম খাতামুননাবীয়ীন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে এসে জানতে পারলেন যে, এখানকার ইয়াহূদীরা আশুরার সিয়াম পালন করে। তিনি তাদের ডেকে তারা কেন আশুরার সিয়াম পালন করে তা জানতে চাইলেন। তারা বলল, তাদের নবী হযরত মূসা আশুরার দিনে বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে নিরাপদে দরিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। তাই তিনি আশুরার সিয়াম পালন করতেন। আমরা তারই অনুসরণে এ সিয়াম পালন করি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমাদের চেয়ে মূসার উপর আমার অধিকার বেশি। এরপর মুহররম মাস এলে তিনি ১০ মুহররম সিয়াম পালন করলেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর অনুসরণ করে সিয়াম পালন করলেন। এই ঘটনার ৭ মাস পর রমাদানের সিয়াম পালন করবার জন্য বিধান নাযিল হলে আশুরার সিয়াম উত্তম নফল সিয়াম হিসেবে থাকল।
হযরত মূসা আলায়হিস সালাম তূর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশে লাগাতার ৪০ দিন ইতিকাফসহ সিয়াম পালন করেন। যেদিন তাঁর ৪০ দিন পূর্ণ হয় সেদিন ছিল ৬ রমাদান। এই দিনই হযরত মূসা আলায়হিস সালাম বেশ কয়েকখানা পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ অবস্থায় তওরাত কিতাব প্রাপ্ত হন। কুরআন মজীদে সেই ৪০ রাতের উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে : আর আমি (আল্লাহ) মূসার জন্য ত্রিশ রাত্রি নির্ধারিত করি এবং আরও দশ দ্বারা তা পূর্ণ করি। এইভাবে তাঁর রব-এর নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রি পূর্ণ হয় (সূরা আ‘রাফ : আয়াত ১৪২)।
সিয়াম বা সওম সাধারণ উপবাস বা উপোস কিম্বা অনশন নয়। এটা আল্লাহর বিধান। এই বিধানে আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেছেন, লা আল লাকুম তাত্তাকুন যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সাবধানী ও সংযমী জীবন লাভ করা, তাকওয়া অর্জন করা।
পারস্যে যুরুস্ত্রুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে রোযা পালনরীতি চালু ছিল। তারা রোযা রাখত নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী, এমনকি পঞ্চবার্ষিকী রোযা রাখার রীতিও তাদের মধ্যে গুরুত্বসহকারে প্রচলিত ছিল। তাদের পুরোহিতগণ বা সাধু-সন্তগণ।
খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীগণের মধ্যে বর্তমানকালে ব্যাপকভাবে উপবাস বা ফাস্টিং রীতি চালু না থাকলেও এই ধর্মের প্রবর্তক হযরত মূসা আলায়হিস সালামের অনুসরণে লাগাতার ৪০ দিন উপবাস পালন করে ছিলেন। তিনি প্রায়শ্চিত্ত দিবসেও ফাস্টিং পালন করতেন সাচ্চা ইয়াহূদীদের মতো। তিনি তাঁর অনুসারীগণকে ফাস্টিং পালনের নির্দেশ দেন। তিনি তাঁর অনুসারীগণকে বলেন : ডযবহ ঃযড়ঁ ভধংঃবংঃ, ধহড়ঁহঃ ঃযরহব যবধফ, ধহফ ধিংয ঃযু ভধপব- যখন তুমি উপবাস থাকবে তখন তোমার মস্তক তেল মেখে পবিত্র করবে এবং তোমার মুখম-ল ধৌত করবে (মথি, ৬:১৭)।
আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলায়হিস সালাম তাঁর এক শিশুপুত্রের রোগমুক্তির জন্য লাগাতার ৭ দিন উপবাস ছিলেন।
বুখারী শরীফে আছে, হযরত দাউদ আলায়হিস সালাম সারা বছর একদিন পর পর সিয়াম পালন করতেন। এই সিয়ামকে দাউদী সিয়াম বলা হয়।
ইয়াহূদীরা উপবাস পালন করে কৃতজ্ঞতা ও মুক্তির নিদর্শনরূপে। অবশ্য তার সঙ্গে পরবর্তীকালে আত্মভর্ৎসনা ও অনুশোচনার ধারণা যুক্ত হয় তাদের এই উপবাসে। তারা উপবাস দিবসও উদযাপন করে।
খ্রীস্টানগণের উপবাস হচ্ছে অনুশোচনা ও প্রায়শ্চিত্তের নিদর্শন। তাদের এই উপবাস হচ্ছে বিশুদ্ধ উপাস্যের ক্রোধ প্রশমনের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়। খ্রীস্টানদের মধ্যে স্বেচ্ছায় রিপু দমনের যে প্রবণতা রয়েছে তা ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক ও দৈহিক শক্তি বিনাশ করার শামিল এবং তাকে অস্বাভাবিক সন্ন্যাসবাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
হিন্দু ধর্মে বেশ গুরুত্বসহকারে উপবাস পালিত হয় একাদশীতে এবং নানা সংক্রান্তিতে। বিয়ের অনুষ্ঠানকালে হিন্দু বর-কনে উপোস থাকে। বুদ্ধের সাধনাকালের ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি পানাহার বর্জন করে দীর্ঘকাল ধ্যানমগ্ন ছিলেন। যার ফলে তিনি কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন।
সকল জাতির মধ্যেই সেই প্রাচীনকাল থেকেই উপবাস পালন করার রীতি চালু আছে। কিন্তু কালের চক্রে আবর্তিত হতে হতে অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রকৃত রীতির চেয়ে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে। তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে অনুশোচনা যুক্ত হয়েছে।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দে রমাদান মাসকে নির্ধারিত করে যে সিয়াম বিধান নাযিল হয় তা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌরভে সুরভিত এক অনন্য বিধান। সিয়াম হচ্ছে সংযমী ও সাবধানী জীবন গড়ে তুলবার জন্য মাসব্যাপী এক অনন্য কার্যকর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং তদনুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী শরীফ)।
সিয়াম পালনকারীকে বলা হয় সায়িম। সায়িমকে সায়িহও বলা হয়। সায়িহ অর্থ রূহানী পথিক। ইলমে তাসাওউফ চর্চার মাধ্যমে সিয়ামের তাৎপর্য জ্ঞান আহরণ করা যায়।


লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.