জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইনুয়িটরা বিপন্ন

আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে কানাডার ইনুয়িট সম্প্রদায়ের মধ্যে পানিবাহিত রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ফলে তারা বিপন্নবোধ করছে। পানির গুণগত মান আরও ব্যাপক পরিসরে নেমে যেতে পারে। ফলে রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাবও সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে।


বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সুমেরু অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বরফও দ্রুত গলছে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানিতে এসে মিশছে নানা ধরনের প্যাথোজেন বা জীবাণু। এসব জীবাণুর কারণে কানাডার ইনুয়িট সম্প্রদায় তাদের মধ্যে রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়ও এ কথার সত্যতা পাওয়া গেছে যা অতীত গবেষণার ফলের সঙ্গে মিশে যায়। দেখা গেছে, সারা বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠী আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বেশি মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার। কারণ তারা বাস করে এমন সব অঞ্চলে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রথম ও সবচেয়ে প্রবলরূপে অনুভূত হয় এবং তারা দৈনন্দিন অধিকতর নিবিড়ভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সংস্পর্শে আসে। যেমন কিছু কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় শহরাঞ্চল থেকে অনেক দূরে থাকায় পরিশোধিত পানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
উত্তরাঞ্চলে ইনুয়িটসহ বেশ কিছু জনগোষ্ঠী পরিশোধিত ট্যাপের পানির বদলে ছোট নদীর পানি পান করে। তাছাড়া শিকার করতে বা মাছ ধরতে গেলে ট্যাপের পানি পানের সুযোগ তাদের হয় না। কাজেই তারা নদীর পানিই পান করে।
জলবায়ু বা আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপখাইয়ে নেয়ার সংগ্রামে নিয়োজিত ইনুয়িট ও অন্যান্য দেশজ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রিস্টাল বলের মতো কাজ করবে। কারণ ওদের অভিজ্ঞতা থেকে এরা বুঝতে না জানতে পারবে আগামী কয়েক দশক দক্ষিণের জলবায়ু বা আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটলে কি হতে পারে।
কানাডার মহামারী তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ শার্লি হারপারের নেতৃত্বে একদল গবেষক সাম্প্রতিক সমীক্ষাটি চালান। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে কি হতে পারে সে নিয়ে প্রায়শই কথা বলে থাকেন। জেমস ফোর্ড নামে অপর এক বিশেষজ্ঞ বলেন, সুমেরু অঞ্চলে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের পরিবর্তন ইতোমধ্যে দেখা গেছে। তিনি আরও বলেন, নতুন সমীক্ষায় এই প্রথমবারের মতো আবহাওয়া পরিবর্তন ও কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর রোগব্যাধির মধ্যে যোগসূত্র টানা হয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা বা সমীক্ষায় পানির সমস্যাগুলো বহুলাংশেই উপেক্ষিত থাকে। বর্তমান সমীক্ষার আগে সুমেরু অঞ্চলে পানিবাহিত রোগব্যাধির বোঝা সম্পর্কে তেমন কোনই ধারণা ছিল না। বর্তমান সমীক্ষা থেকে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে আবহাওয়ার পরিবর্তন রোগব্যাধির ক্ষেত্রেও কোন পার্থক্য রচনা করে কিনা তা নির্ণয় করার সুযোগ পাওয়া যাবে।
আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পানিবাহিত রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাবের ওপর কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে বহুবর্ষী তুলনামূলক সমীক্ষার অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। গবেষক দলটি উগান্ডার বাতওয়া পিদামী ও পেরুর শিপিবো জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অনুরূপ সমীক্ষা চালাচ্ছে। সমীক্ষা এখনও চলছে। তবে প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, ইনুয়িটদের মতো এই সম্প্রদায়গুলোও স্বাস্থ্যের ওপর আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় আবহাওয়ার প্যাটার্ন পানির সাপ্তাহিক পরীক্ষা এবং ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদির ক্লিনিক্যাল তথ্য রেকর্ড করা হয়। এসব তথ্য একত্রিত ও বিশ্লেষণ করে কতগুলো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় জানা যায়। যেমন দেখা গেছে যে, ভারি বৃষ্টিপাত বা দ্রুত বরফগলার অধ্যায়ের পর পানিতে ই, কোলাইয়ের মতো ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে এবং দুই থেকে চার সপ্তাহ পর ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উগান্ডায় দেখা গেছে, যেসব পরিবার তাদের গৃহপালিত পশুকে আশ্রয়স্থলে রাখে না ভারি বৃষ্টিপাতের পর তাদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। গবেষকদের ধারণা, এসব পশুর মলমূত্র বৃষ্টি বিধৌত হয়ে খাওয়ার পানিতে গিয়ে মিশে।
ইনুয়িটদের ছোট শহর রিগোপেটে হারপারের দলের পরিচালিত সমীক্ষার ফল ইতোমধ্যে ঐ সম্প্রদায়ের জীবনে কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছে। শহরের মেয়র চার্লট উলফ্রে জানান, লোকজনকে নদীর পানি পান না করে ব্যাকটেরিয়া দমনের জন্য ক্লোরিনযুক্ত পানি খেতে বলা হয়েছে। শহরের সর্বত্র পোস্টার টাঙিয়ে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, অশোধিত পানি পান করার আগে তাঁরা যেন তা আগে ভালমতো ফুটিয়ে নেয়। উলফ্রে বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এই শহরের জনগণ এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে যেগুলো আগে স্বতসিদ্ধ বলে ধরা হতো। যেমন বরফাচ্ছাদিত কোন কোন জায়গা দিয়ে নিরাপদে পাড়ি দেয়া যায় কিংবা নৌকা চলাচলের মৌসুমী জলপথ কোথায় অবস্থিত। আগে এই সংক্রান্ত জ্ঞান বা ধারণা প্রজন্ম পরম্পরায় চলে এসেছিল। আজ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে লোকে এসব ধারণার ওপর আর ভরসা করতে পারে না। রিগোলেটের ইনুয়িট সম্প্রদায় ও অন্যান্য আদিবাসীর এসব অভিজ্ঞতা থেকে যা শিক্ষা পাওয়া গেছে তাতে একদিন সামগ্রিকভাবে মানবজাতিরই উপকার হবে। কারণ তাদের সমস্যা অচিরেই বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে একবিংশ শতাব্দীতে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিত রোগব্যাধির সিংহভাগই হবে ডায়রিয়া রোগ।
হারপার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিত পানিবাহিত রোগব্যাধির প্রকোপ শুধু আর্কটিক বা সুমেরু অঞ্চলের কিংবা স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমস্যা নয়, তবে তিনি সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তন এমন এক সমস্যা যার সমাধান মানুষ দিতে না পারলেও এর সঙ্গে নিজেদের খাপখাইয়ে নিতে পারবে। তবে তার জন্য সবাইকে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
প্রকৃতি ও বিজ্ঞান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.