পিপুফিশো by মোফাজ্জল করিম

মফস্বলের এক আদালতে বিচারকের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী যখন বলল, তার বয়স তেত্রিশ, মাননীয় বিচারক তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, কী হে, গত পাঁচ বছরে তুমি অন্তত ছয়টি মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসেছ এই আদালতে। প্রতিবারই বয়স জিজ্ঞেস করলে বল তেত্রিশ।


তোমার বয়স কি তেত্রিশে এসে থেমে গেছে নাকি? ওটা কি আর বাড়বে না কোনো দিন? নাম্বার ওয়ান ধড়িবাজ সাক্ষী বলল, হুজুর, একবার হলফ নিয়ে যা বলেছি তা এখন বদলালে সেটা কি মিথ্যা বলা হবে না? আদালতে দাঁড়িয়ে হলফ নিয়ে একই বিষয়ে আজকে আবার নতুন কথা বলা কি ঠিক? আপনিই বিবেচনা করুন। তা ছাড়া ভদ্রলোকের এক কথা বলেও তো একটা কথা আছে।
সাগর-রুনির হত্যা মামলার তদন্তের কী খবর? সাংবাদিকদের এ রকম প্রশ্নের উত্তরে আমাদের চৌকস তদন্তকারীদের জবাব কয়েক মাস ধরে একটাই : অগ্রগতি হচ্ছে। শুধু তাঁরা কেন, তাঁদের বসরাও কথা বলেন মোটামুটি একই ভাষায়। মাঝখানে বিরতি একটু বেশি হয়ে গিয়ে থাকলে 'উল্লেখযোগ্য' বা ওই রকম একটা বিশেষণ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে জবাবের আগে। তাতে অবশ্য বক্তব্যের কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হচ্ছে না।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারিত ৪৮ ঘণ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে স্বভাবতই ব্রীড়ানত ভঙ্গিতে তিনি বিব্রতবোধ করেন। কখনো বা একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চান, ওটা ছিল একটা বাত কি বাত। আপনারা সব কথা অত সিরিয়াসলি নেন কেন? সব কিছু কি আর শব্দার্থে নিলে চলে? অবশ্য তিনিও তাঁর কথায় অনড় থেকে এখনো বলতে পারেন, অপরাধীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ধরতে হবে, এতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আমি আগেও বলেছি ৪৮ ঘণ্টা, এখনো বলছি ৪৮ ঘণ্টা।
এখন অবশ্য ইলিয়াস আলী-নূরুল ইসলাম ইত্যাদি 'এপিসোডে' সর্বশেষ নীতি হচ্ছে, 'সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন'- নীরবতা হিরণ্ময়। বোবার যে শত্রু নাই অন্তত এটা তাঁরা ভালো করেই ঠেকে শিখেছেন।
আমাদের দেশে আরেকটা খুব সুন্দর প্রবচন আছে : বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলা/মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলা। বিরোধী দলের এত যে হম্বিতম্বি, আন্দোলনের হুমকি-ধমকি, দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড়, প্রায় প্রতিদিন ঢাকায়-অঢাকায়, স্থানে-অস্থানে মিটিং-মিছিল, মানববন্ধন-মানবীবন্ধন, এর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই আমাদের নির্লিপ্ততায় গৌতম বুদ্ধ পদক পাওয়ার যোগ্য প্রশাসনের। পক্ষাঘাতে হাত বা পা অবশ হয়ে যাওয়া মানুষের বোধশক্তিহীন হাতটি বা পাটিতে যেমন মস্তিষ্কের কোনো নির্দেশ পৌঁছে না, আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কানে ইলিয়াস আলীর মেয়েটির কান্না কিংবা একজন লিমনের আর্তনাদ অথবা মানববন্ধন-মিছিল-মিটিং থেকে উৎসারিত সহস্র কণ্ঠের প্রতিবাদ কোনো 'মেসেজ' পৌঁছতে বোধ হয় ব্যর্থ হয়। তা না হলে তাঁরা কি বোঝেন না, ইলিয়াস আলীর মেয়ের যে শোকবিধ্বস্ত জীবন, লিমনের সারা জীবনের সঙ্গী যে কান্না তা তাঁদের ছেলেমেয়ের বেলায়ও হতে পারত।
আমরা ক্ষমতায় আছি বলে কি আমাদের চিন্তাশক্তি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে? আমরা একটিবার নিজেকে বা আমার ভাইকে, বোনকে, সন্তানকে ইলিয়াস আলী বা তাঁর কন্যার জায়গায়, লিমন বা তার দরিদ্র অসহায় মা-বাবার জায়গায়, এক লহমায় পৃথিবীতে অনাথ হয়ে যাওয়া মেঘের অবস্থানে বসিয়ে জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করি না কেন? আল্লাহ না করুক, অমন পরিণতি হলে, আর তখন প্রশাসন কানে তুলা দিয়ে এবং পিঠে কুলা বেঁধে রাখলে সহ্য করতে পারব আমি, আপনি বা আমাদের দুস্থ স্বজন? পারব না। কোনো মানুষ পারে না।
কিন্তু মানুষের স্বভাবটাই এমন যে যতক্ষণ পর্যন্ত না যন্ত্রণার তীরে সে নিজে বিদ্ধ হয়, ততক্ষণ ওই তীর অন্য কাউকে বিদ্ধ করলে তার কিচ্ছু যায় আসে না। 'কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।'
সমস্যাটা ওইখানেই। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমরা সব আপদ-বালাই, অভাব-অনটন থেকে এতটা অন্তরিত (ইনসিউলেটেড) থাকি যে তখন অন্যের দুঃখটা, কষ্টটা মোটেই আঁচ করতে পারি না। অথবা আমরা আঁচ করতে চাই শুধু ততটুকু, যতটুকু আমাদের আঁচ করতে বলা হয়। প্রশাসনে তো আমাদের বেশির ভাগের কাজই হচ্ছে নির্দেশিত হয়ে কিছু করা। আমাদের প্রায় সব আদেশ-নির্দেশসংবলিত সরকারি চিঠির শুরুতেই বলা হয় : 'নির্দেশিত হইয়া জানান যাইতেছে যে ...।' নির্দেশটা কে দিয়েছেন, তিনি-'কিনি', বলা যাবে না। তিনি নেপথ্যের এক 'রহস্যময়' অদৃশ্য সত্তা। তথ্য-অধিকারের যতই আইন-টাইন করুন না কেন, তাঁর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না।
তবে হ্যাঁ, লোকে ঠিকই জানে, 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস' বলে বলে চেঁচিয়ে মুখে ফেনা তুললেও ক্ষমতার উৎস ওই বক্তারাই। তাঁরা ধর বললে ধরা হয়, ছাড় বললে ছাড়া হয়। তাঁদের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পেলে তদন্তের গাড়ি মোটেই আগাবে না, যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ব্যস্ত গার্ড সাহেবকে গাড়ি ছাড়ার কত দেরি জিজ্ঞেস করলে তিনি ওই 'অগ্রগতি হয়েছে', 'উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে' মার্কা জবাব দিয়ে যাবেন। আর যখন তাঁর মর্জি হবে তখন তিনি দয়া করে সবুজ সংকেত দেখাবেন, আর সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করবে গাড়ি। সেই ন'টার গাড়ি অবশেষে ক'টায় ছাড়ল সে ব্যাপারে তাঁর কোনো জবাবদিহি নেই। অথচ আইন-কানুন, বিধি-বিধানের কথা যদি বলেন, তবে সব ব্যাপারেই সেগুলো দারুণ কড়া আমাদের দেশে। রেলগাড়ি কোনটা কয়টায় ছাড়বে যেমন একটা সময়সূচি মেনে চলে, তেমনি ফৌজদারি কোনো মামলার তদন্ত কত দিনে শেষ হবে, দেশশুদ্ধ মানুষ যে লোকটাকে খুনি বলছে সে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়ালে পুলিশ তার হাতে হাতকড়া পরাবে, না ফুলের তোড়া তুলে দেবে- এ সবই আমাদের ব্রিটিশ গুরুদেবরা অনেক খেটেখুটে আইনের বইয়ে লিখে রেখে গেছেন দেড় শ-দুই শ বছর আগে।
পুরনো বলেই বোধ হয় এখন এগুলোকে মনে করা হয় বাসি। এগুলো যেসব কর্তাব্যক্তির মেনে চলার কথা তাঁরা ভাবেন, এসব ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে একটা স্বাধীন দেশ চলতে পারে না। এখন স্যার যা বলবেন সেটাই আইন, মহারানি ভিক্টোরিয়া আর লর্ড ম্যাকলের আইন তো আর এই ডিজিটাল যুগে চলতে পারে না।


ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহ্যের ধারক মনোরম ছাত্রাবাসটি কিছু পাষণ্ড 'এসিড মেরে' পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রায় এক মাস পার হয়ে গেছে। এখন এই ভস্মীভূত স্থাপনাগুলো থেকে আর বেদনার নীল ধোঁয়াও উঠছে না।
যে রাতে ওই ঘটনা ঘটে, আমি সে রাতে ঘটনাচক্রে সিলেট শহরেই অবস্থান করছিলাম। পরদিন সকালে ব্যাপারটি জানাজানি হলে দলমত-নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ এক স্বজনহারা বেদনা অনুভব করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে অনেকে। দিনকাল ভালো নয়, সে কারণে মানুষ হয়তো রাজপথে তেমন একটা নামেনি। শুধু তীব্র শোক ও ক্ষোভ বুকের মধ্যে ধারণ করে দলে দলে মানুষ গিয়েছিল ওই ধ্বংসলীলা দেখতে।
ওই কলেজের ছাত্র না হলেও এমসি কলেজ ও তার অনুপম স্থাপনাগুলো আমার স্মৃতিতে চির অম্লান হয়ে আছে। ছাত্র হতে না পারার আক্ষেপ অনেকখানি পুষিয়ে গিয়েছিল ওই কলেজে বছর তিনেক (১৯৬৩-৬৬) শিক্ষকতা করার সুবাদে। ওই তিনটি বছর আমার জীবনে তিন টুকরো হীরের মতো। এর ভেতর প্রথম দেড় বছর আমাকে রোজ অন্তত দুইবার করে হেঁটে যেতে হতো নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যঘেরা ছাত্রাবাসের সামনে দিয়ে। আমি তখন ছাত্রাবাসের নিকটবর্তী করিমুল্লাহ হাউস নামক শিক্ষক নিবাসের বাসিন্দা। ১৯৬৬ সালের পর সেদিন গেলাম সেই সুন্দরীর চিতাভস্ম দেখতে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এর আগে ওখানে গিয়ে যে ক্ষোভ, ঘৃণা ও শোক প্রকাশ করেছেন, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তাঁরা দুজনই এমসি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। জনাব নাহিদ তো ওই ছাত্রাবাসেই থাকতেন। নিশ্চয়ই তাঁর অনেক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই সাদা দেয়াল, কালো খুঁটি ও লাল টিনের টোপর মাথায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী প্রকোষ্ঠগুলোর আনাচে-কানাচে। যেসব 'পাশব বলের আসবমত্ত' দুর্বৃত্ত এই সুন্দর স্থাপনাগুলোকে আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে নিমিষে ভস্মীভূত করে দিল, জনাব নাহিদ বা জনাব মুহিতের নিশ্চয়ই ইচ্ছা হচ্ছিল ওই মুহূর্তে আরেকটি বিশাল চিতা জ্বালিয়ে তাদের ওই চিতার আগুনে ছুড়ে মারতে। কিন্তু তাঁরা যতই তীব্র প্রতিবাদ জানান, যতই অশ্রু ঝরিয়ে ও নীরব বিলাপে বাতাস ভারী করুন, তাঁরা আসলে কিছুই করতে পারবেন না। এসব ব্যাপারে তাঁরাও আমাদের মতো পাবলিক! গাড়ি ছাড়ার সবুজ সংকেত দেওয়ার মালিক তাঁরা নন। এখন তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পতাকা হাতে গার্ড সাহেবও নাচার, এখন স্টেশন মাস্টার সাহেব বললেই তবে গাড়ি ছাড়বে। আর স্টেশন মাস্টার সাহেব গায়েবি আওয়াজ না আনা পর্যন্ত বসে থাকবেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে।


কিংবদন্তির সেই আলসের কথা মনে আছে? সেই যে দুই আলসে ঘুমাচ্ছে তো ঘুমাচ্ছে। সেই 'কত রবি জ্বলে রে, কেবা আঁখি মেলে রে' অবস্থা। এমন সময় ঘরে লেগেছে আগুন। আগুনের তাপে ওদের একজনের নিদ্রা গেছে চটে। সে দুই আঙুল দিয়ে টেনে কোনোমতে এক চোখের পাতা দুটো ফাঁক করে দেখল সত্যি আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ঘর। সেই সঙ্গে তার পিঠও। ব্যাপারটি সে তার নিদ্রিত সঙ্গীকে জানানো উচিত মনে করল; কিন্তু অলস মানুষ, 'পিঠ পুড়ছে'- এই পুরো কথাটি কষ্ট করে বলে কী করে। সে কোনোমতে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে সংক্ষেপে বলল : পি. পু। অর্থাৎ পিঠ পুড়ছে। অন্যজন তার সিনিয়র, তার বস। সে আরেক কাঠি সরেস। আগুনের তাপ সেও টের পাচ্ছে। সে জবাব দিল : ফি. শো. (ফিরে শো)। অর্থাৎ পিঠ পুড়ছে? ঠিক আছে, পাশ ফিরে শুলেই হবে।


ছাত্রাবাস পুড়ে ছাই হয়ে গেল, এলাকার লোক একবাক্যে বলল কারা পুড়িয়েছে, পত্রপত্রিকায় ওইসব বীরপুরুষের 'অ্যাকশন পিকচারও' ছাপা হলো, এমনকি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির দারোগাবাবুও 'অশ্বত্থামা হত, ইতি গজঃ'-এর মতো করে বলে দিলেন অপরাধী কারা, তার পরও দিন যায়, মাস যায়, হয়তো বছরও যাবে, অপরাধীরা ধরা পড়ে না।
যে জাতি পিঠে আগুনের লেলিহান শিখা ছোবল মারার পরও পি. পু. ফি. শো. নীতিতে অবিচল থাকে, তাদের পরিণতি কী, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্রেকিং নিউজ : অবিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারীরা নাকি অপেক্ষায় আছে, কবে নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণের ছয় কোটি টাকার টেন্ডারটি ডাকা হবে!

mkrnim06@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.