নারী অধিকার আদায়ের মডেল কিশোরী সুম্পা- বলতে চাই by মেজবাহউদ্দিন মাননু

কেবল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। এইটুকু শিক্ষাজীবনে অন্তত চারটি বছর তার কেটেছে বাল্যবিয়ে, বহুবিবাহসহ নারী নির্যাতনবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেকটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছে সে। তার নাম সুম্পা বেগম। সবাই সুম্পা নামেই তাকে চিনে।


অথচ সেই সুম্পার জীবনেই বাল্যবিয়ে নামক জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, স্কুল থেকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে তাকে বলা হলো তার বিয়ে দেয়া হবে। ভাড়াটে এক হোন্ডাচালক তরুণ ছেলেটি তার সারা জীবনের সঙ্গী। তাকে নিয়েই ঘর সংসার করতে হবে। আচমকা বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে থমকে যায় সুম্পার সকল ভবিষ্যত স্বপ্ন। কোন উপায় না পেয়ে সোজা দৌড়ে স্কুলে যায় সে। শিক্ষকদের কাছে আশ্রয় চায়। সেখান থেকে একেক করে উপজেলা প্রশাসনের সকল পর্যায়ে। সুম্পা অবিচল থেকে নিজের জন্মদাতা বাবাকে জেলে পাঠায় । তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে সোহরাব তালুকদারকে গ্রেফতার করানোর ব্যাপারে একটুও অনুকম্পা দেখায়নি সুম্পা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীর আদালত সোহরাব তালুকদারকে এক মাসের বিনাশ্রম দ-াদেশ দেয়।
অজপাড়াগাঁয়ের অনগ্রসর জনপদের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুম্পা এখন প্রতিবাদী কিশোরী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ সৃষ্টি করে বাল্যবিয়ের খ—গ থেকে এ যাত্রা নিজেকে রক্ষা করেছে সে। তবে এজন্য তাকে একদফা বাড়িঘর ছেড়ে বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। শুধু লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার দৃঢ় মনোবল নিয়ে এই কিশোরী যেন যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, সুম্পার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলাতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনসহ অন্য শিক্ষকরা সুম্পার পাশে পিতৃস্নেহে এগিয়ে আসায় বাল্যবিয়ের কবল থেকে সুম্পা নিজেকে এ যাত্রা রক্ষা করতে পেরেছে।
সুম্পা খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা জেলে। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামে সুম্পাদের বাড়ি। তুলাতলী স্কুলের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের সকল অনুষ্ঠানের অগ্রভাগে বিচরণ ছিল সুম্পার।
বাল্যবিয়ে, বহুবিবাহসহ এ ধরনের সমাজ হিতৈষী কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখত এই কিশোরী। বক্তৃতা করত সমাবেশে। করেছে নাটক পর্যন্ত। সেই শিক্ষা থেকেই প্রতিজ্ঞা তার, একদিন নিজে লেখাপড়া শিখে বড় হবে। হবে সমাজ উন্নয়নের একজন নারীনেত্রী। কিন্তু নিজের জীবনের ওপর বাল্যবিয়ের মতো নেমে আসা খ—গকে মোকাবেলা করতে হবে তা বুঝে ওঠতে পারেনি এই কোমলমতি কিশোরী।
যেখান থেকে সূত্রপাত
৬ জুলাই রাতে সুম্পাকে তার কোন মতামত ছাড়াই কাবিন ছাড়া বিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওইদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারে আমতলী উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের নাচনাপাড়া গ্রামের ছোবাহান প্যাদার ছেলে ভাড়াটে হোন্ডাচালক ছোলায়মানের (১৭) সঙ্গে তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিষয়টি সুম্পা শিক্ষকদের জানায়। একদিন পরে স্থানীয় দফাদার সোহরাব হোসেনের সহায়তায় প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন কিশোরী সুম্পাকেসহ তার কথিত স্বামী ছোলায়মান, সুম্পার বাবা সোহরাব তালুকদার, বিয়ের মধ্যস্থতাকারী সুম্পার ফুফু সুমা বেগম ও ঘটক মুক্তার আলীকে আটক করে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নেয়া হয়। ইউএনও দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বিষয়টি শোনার পরে সবার যৌথ সিদ্ধান্তে লিখিত মুচলেকায় বিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং যে যার মতো বসবাস করবেÑএমন সমাধান করা হয়। এমনকি সুম্পা আগের মতো স্কুলে যাবে। কিন্তু বিষয়টি মানসিকভাবে মেনে নেয়নি সোহরাব তালুকদার, ছোলায়মান, সুম্পার ফুফু সুমা বেগম, দাদা নাগর আলী তালুকদার এবং ঘটক মুক্তার আলীসহ কয়েকজন। সুম্পার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। চাপ প্রয়োগ করা হয় কথিত স্বামীর সঙ্গে ঘরসংসার করতে হবে। অবশেষে কোন উপায় না পেয়ে ১৭ জুলাই, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সুম্পা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে আশ্রয় নেয়। সুম্পার সবার কাছে আকুতি জানায়, আপনাদের মেয়ে হলে আপনারা রক্ষা করতে পারতেন না?
এমন আকুতির প্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই ফের গ্রেফতার করা হয় সুম্পার বাবা ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে সোহরাব তালুকদারকে। অন্যরা এ সময় পালিয়ে যায়। তুলাতলীতে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ইউএনও দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী সুম্পার বাবাকে একমাসের দ-াদেশ দেন।
এছাড়া সুম্পাকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হেফাজতে দেয়া হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই শেষ বিকেলে সুম্পার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলাতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কুয়াকাটাগামী বিকল্প সড়কে শত শত শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় সুধীবৃন্দ এ ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনে কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির, সুম্পাসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। শত শত মানুষের উপস্থিতিতে সুম্পাকে তার দাদা নাগর আলী তালুকদারের হাতে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু সুম্পার মনে এখনও এক অজানা শঙ্কা সবসময় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার বাবা জামিনে এসে যদি বিষয়টি মানসিকভাবে মেনে না নেয়। তাহলে তার পরিণতি কি হবে। এমন নানা দুশ্চিন্তায় কিশোরী সুম্পার একেকটি মুহূর্ত কাটছে।
কিশোরী সুম্পা বাল্যবিয়ে থেকে নিজেকে রক্ষা করতে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সেটি আসলেই আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে থাকবে। যেন কথিত সচেতন সমাজকে এক হাত দেখিয়ে দিল সে। শেখাল প্রতিরোধ কিভাবে করতে হয়। নিজেকে দাঁড় করাল ইস্পাত কঠিন মনোভাব নিয়ে। যখন এক এক করে তুলাতলী মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি মেয়েদের শিক্ষাজীবনে বাল্যবিয়ের খ—গ চেপে বসছিল ঠিক ওই সময় অদম্য প্রতিরোধ গড়ে তুলল সে।
এরপরই তুলাতলীর গোটা সমাজব্যবস্থা আরও সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে। ছোট্ট, কোমলমতি কিশোরী এই সুম্পা যেন আমাদের পথ দেখাল কিভাবে প্রতিরোধ করতে হয় বাল্যবিয়ের মতো ঘৃণ্য কাজকে। বর্তমানে কলাপাড়ার গোটা উপকূলে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বাল্যবিয়েসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- বন্ধে নামকাওয়াস্তে সভা-সমাবেশ করে আসছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সুম্পার কোন সহায়তায় এরা কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই তাদের কর্মকা- নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি শঙ্কাও থেকে যায় সুম্পার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন কিভাবে ঘটবে।

No comments

Powered by Blogger.