ঢাকার বাতাসে বিষ by বিপ্লব রহমান

রাজধানীর বায়ুদূষণের পরিমাণ এখন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত চার মাসে ঢাকায় যে পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটেছে, তা গত চার বছরের যেকোনো একটি বছরের মোট দূষণের চেয়েও বেশি। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও কারখানার কালো ধোঁয়ার কারণে ঢাকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক বিষ।


গবেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তো বটেই, এমনকি দূষণের কারণে ফলবতী গাছগাছালিও বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে শস্য ও ফল উৎপাদন। জীববৈচিত্র্যেও পড়ছে নানা নেতিবাচক প্রভাব। দিন দিন ভয়াবহ এ দূষণ ক্রমেই চলে যাচ্ছে আয়ত্তের বাইরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষকের করা সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে এসব কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মান অনুযায়ী, গড়ে আট ঘণ্টায় প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ১০ হাজার মাইক্রোগ্রাম কার্বন মনোক্সাইড, ১০০ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ১ দশমিক ৫৭ মাইক্রোগ্রাম ওজোন এবং গড়ে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘন মিটারে ৩৬৫ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস থাকলে তা হবে পরিবেশের জন্য সহনীয়।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, অথচ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- শুধু এই চার মাসে রাজধানীর বাতাসে যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তা ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের একেকটি বছরের মোট বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে! ঢাকার বাতাসে ওই চার মাসে গড়ে আট ঘণ্টায় প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ২৩ হাজার ৫৭৪ মাইক্রোগ্রাম কার্বন মনোক্সাইড, ৭৮৫ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ৩৬৮ মাইক্রোগ্রাম ওজোন এবং গড়ে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘন মিটারে ৯১২ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ইটখোলায় জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের কয়লার ব্যবহার, কলকারখানায় প্রতিরোধক ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে রাজধানীতে বিষাক্ত গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে বলে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। ঢাকায় যানবাহন, শিল্প-কারখানা এবং আশপাশে ইটখোলার সংখ্যা দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে অন্য শহরগুলোর তুলনায় ঢাকায় দূষণের মাত্রাও অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ্ মোহাম্মদ উল্লাহর তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক শারমিন জাহান ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে এই গবেষণা চালাচ্ছেন। তিনি টিজি মনিটরের সাহায্যে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি রেকর্ড করে গবেষণায় নানা তথ্য-উপাত্ত যোগ করছেন। শারমিন জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার ১০টি অঞ্চলের বাতাস পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দিন দিন বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে মৌচাক, সায়েদাবাদ, সায়েন্স ল্যাব, মহাখালী, মতিঝিল, তোপখানা রোড, ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকার বাতাস তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দূষিত।'
অধ্যাপক ড. শাহ্ মোহাম্মদ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এসব যানবাহনের জ্বালানি পুরোপুরি পোড়ে না বলে তা বাতাসে ক্ষতিকারক কার্বন মনোক্সাইডসহ অন্যান্য গ্যাসীয় উপাদান ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার শিল্প-কারখানাগুলো সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ নির্গমন করছে। এর মধ্যে ইটখোলায় অনুন্নতমানের কয়লা পোড়ানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, 'বায়ুদূষণের কারণে আমাদের শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। দেখা দিচ্ছে চর্মরোগ, এমনকি ত্বকের ক্যান্সারও। রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় নানা ধরনের রোগ-বালাই বাড়ছে। শিশুদের শারীরতন্ত্র অনেক কোমল থাকে বলে তারাই এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বাতাসে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ফল ও ফুলের রেণু, মাছের ডিম ও পোনা নষ্ট হচ্ছে। এতে শস্য ও ফল আগের চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। অনেক ফলবতী বৃক্ষ পুরোপুরি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাছ মরে যাওয়ার অন্যতম কারণও এই বায়ুদূষণ।'
গবেষণা তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে ঢাকায় প্রতি ঘন মিটার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ছিল গড়ে ৩৩৯ দশমিক ২৩ মাইক্রোগ্রাম। ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৮ দশমিক ১৩ মাইক্রোগ্রামে। ২০১০ সালে বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি ঘন মিটারে ৫৩৮ দশমিক ২০ এবং ২০১১ সালে ৬২৮ দশমিক ১২ মাইক্রোগ্রামে দাঁড়িয়েছে।
২০০৮ সালে ঢাকায় প্রতি ঘন মিটার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের হার ছিল ২১৯ দশমিক ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। ২০০৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৭১ দশমিক ১২ মাইক্রোগ্রাম। ২০১০ সালে ২৯৭ দশমিক ০১ এবং ২০১১ সালে তা বেড়ে ৩১২ দশমিক ৫০ মাইক্রোগ্রাম হয়।
একইভাবে বাড়ছে কার্বন মনোক্সাইডের হারও। ২০০৮ সালে ঢাকার বাতাসে এর গড় মাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ১২৪ দশমিক ৩০ মাইক্রোগ্রাম, ২০০৯ সালে পাঁচ হাজার ১১৬ দশমিক ২০ মাইক্রোগ্রাম, ২০১০ সালে পাঁচ হাজার ৯৪৬ দশমিক ২১ মাইক্রোগ্রাম এবং ২০১১ সালে ছয় হাজার ১২০ দশমিক ১৩ মাইক্রোগ্রাম।
২০০৮ সালেও ওজোনের পরিমাণ ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ওই বছর প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ৭১ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম ওজোন থাকলেও ২০১১ সালে প্রতি ঘন মিটারে এর পরিমাণ দাঁড়ায় গড়ে ১২০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ২০০৯ সালে ১০৫ দশমিক ২ এবং ২০১০ সালে ১২০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম ওজোন ছিল।

No comments

Powered by Blogger.