শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সমাজের মৌলিক রূপান্তর এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সাধন করা। রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ানো উচিত আমাদের এবং তা যত দ্রুত সম্ভব। শিক্ষা খাতে রাষ্ট্র স্ব-উদ্যোগে বিনিয়োগে আগ্রহী হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় রাষ্ট্রই।


আসন্ন ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি প্রত্যাশার জায়গাটি অনেক বড়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি কখনও কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে যে 'জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০' গৃহীত হয়, সেখানে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন কীভাবে ও কী পরিমাণে হবে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনাই রাখা হয়নি। অথচ ২০০৯ সালে সরকার যে খসড়া শিক্ষানীতি জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিল সবার মতামতের জন্য, সেখানে অর্থায়ন নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ই ছিল এবং প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য অর্থ বরাদ্দের একটি হিসাব তাতে দেখানো হয়েছিল। খসড়া শিক্ষানীতিতে ২০১৯ সালের ভেতর শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে প্রতি অর্থবছরে প্রাক্কলিত সম্ভাব্য অর্থ বরাদ্দের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটা ছিল শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে নূ্যনতম চাহিদা ও তা জোগানদানে সরকারের সক্ষমতার প্রেক্ষিতে। তাহলে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতিতে কেন এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবেই চেপে যাওয়া হলো? খেয়াল করলেই দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বমোট বাজেট ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার। ওই বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে যৌথভাবে ২০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল এবং এর মধ্যে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা, যা খসড়া শিক্ষানীতিতে শুধু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২০১১-১২ অর্থবছরে যে প্রাক্কলিত সম্ভাব্য বরাদ্দের প্রয়োজন নির্ধারণ করা হয় (২৭,১২০ কোটি টাকা) তার থেকে অনেক কম। শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় নূূ্যনতম বরাদ্দ নিয়ে সরকারের এমন লুকোচুরি খেলা আসলে সরকারের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তাই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রতি অর্থবছরে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন এবং কীভাবে তা সরকার উত্তোলন করবে তা জনসমক্ষে স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া এবং আসন্ন ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যাতে খসড়া শিক্ষানীতিতে উলি্লখিত সম্ভাব্য বরাদ্দ ৩২,২৪৫ কোটি টাকা থেকে কোনোভাবেই না কমে, সে ব্যাপারে এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
আরও একটি বিষয়ে সরকারকে স্বচ্ছ হতে হবে জরুরিভাবে। প্রায় প্রতি বছরেই বাজেটে শিক্ষা খাতে যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দানের বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হয়; সেখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে। আজ পর্যন্ত প্রতি বাজেটেই শিক্ষা খাতের সঙ্গে প্রযুক্তি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, ধর্মসহ নানাবিধ খাত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বরাদ্দকৃত স্বল্প অর্থটুকুও ভাগাভাগি হয়ে যায় অন্যান্য খাতের সঙ্গে। ২০০৭-০৮ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তির সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতকেও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল! সরকার নতুন শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছে। এটি বাস্তবায়নের দায়ও সরকারের। শিক্ষার সঙ্গে অন্যান্য খাতকে জুড়ে দেওয়ার ফলে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের অভাবে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম না হলে, সরকার নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়_ এমনটাও অনেকের মনে হতে পারে।
উচ্চশিক্ষা খাতে অর্থায়নের বিষয়টি আরও ঝামেলাপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রণীত ২০০৬-২৬ পর্যন্ত ২০ বছরব্যাপী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে Strategic Plan রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার যে ৫টি সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে অপর্যাপ্ত অর্থসংস্থান! শিক্ষা খাতের সমগ্র ব্যয়ের মাত্র ১১% উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় খাতে সরকার ব্যয় করে প্রতিবছর, যা জিডিপির মাত্র ০.১২%। মঞ্জুরি কমিশনের রিপোর্টে এই উভয় অনুপাতকে নূ্যনপক্ষে দ্বিগুণ থেকে আড়াই গুণ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান যথাযথ পর্যায়ে নিতে হলে তার মাত্রা হওয়া উচিত অন্তত জিডিপির ০.৩০%। সেই হিসাবে ২০১০ সালে উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রয়োজন হতো ২২৪৬ কোটি টাকা (জিডিপির ০.৩%)। কিন্তু বাস্তবে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৮৯৮ কোটি টাকা। স্বভাবতই এই ব্যয়ে উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব হয় না; উপযুক্ত অবকাঠামো, ছাত্রাবাস ও যাতায়াত সুবিধা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। সম্ভব হয় না পর্যাপ্ত ICT ব্যবস্থার আয়োজন করা। সুতরাং আমাদের ভেবে দেখতে হবে কীভাবে আমরা শিক্ষা বাজেট আরও বাড়াতে পারি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অর্থ উত্তোলনের জন্য সমাজের বিত্তশালীদের কাছ থেকে শিক্ষা কর আদায়সহ নানাবিধ পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করতে পারে।
উচ্চশিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গবেষণা কার্যক্রম, যা হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও বাড়ানো হয়নি গবেষণা খাতে বরাদ্দ। ২০১০ সালের ২৬ জুন প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'মৌলিক গবেষণাশূন্য ১৫ গবেষণাকেন্দ্র'। গবেষণাকেন্দ্রগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৫টি গবেষণাকেন্দ্রের জন্য এক শিক্ষাবর্ষে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ২৪ লাখ টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৫টি গবেষণাকেন্দ্রের মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য এক বছরে সাড়ে ২৪ লাখ টাকা কি পর্যাপ্ত? গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাপ্ত বরাদ্দ ও ব্যয়ের ব্যাপারে দু'একটি উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় (Washington University in St. Louis) ২০০৬ অর্থনৈতিক বর্ষে গবেষণা করার জন্য ফেডারেল রিসার্চ ফান্ড থেকে ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার লাভ করে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বার্ষিক বরাদ্দ ((Endowment) হচ্ছে ১৪৪ কোটি সিঙ্গাপুর ডলার (তথ্যসূত্র :সাপ্তাহিক একতা, ২৫ জুন, ২০১১)। আমরা বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র বা সিঙ্গাপুরের মতো ধনী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ বরাদ্দ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখনি দিতে হবে। কিন্তু গবেষণার নূ্যনতম বরাদ্দটুকুও যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা করার উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে যেমন তার মান হারাবে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তার মূল কাজটিও স্থবির হয়ে পড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি শিক্ষার্থীকে মাসে ১২ হাজার রুপি বৃত্তি দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে গবেষণা করার জন্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা লক্ষণীয়। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। এ জন্য গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই_ এ কথা বলে গবেষণার মতো মৌলিক বিষয় এড়ানো যাবে না। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব বাজেটের প্রায় ৫৮ শতাংশ ব্যয় দেখানো হয় সিভিল প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা খাতের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে। এসব অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় কমিয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা কি শুধু গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা যায় না? শিক্ষা খাতে ব্যয় যেহেতু বিনিয়োগ, সেহেতু রাষ্ট্রের অনুৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা খাতে যদি বরাদ্দ বাড়ানো যায়, তাহলে তার ফল পেতে বেশি সময় লাগবে না। শিক্ষায় ব্যয় বাড়ানোর ফলে যে খরচ হবে, সেটি অদূর ভবিষ্যতেই উঠে আসবে। উন্নত পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ সরবরাহ; সর্বোপরি স্কুল শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে উপায় নেই। রাষ্ট্রের বিলাসী খাতে বরাদ্দ ক্রমশ না বাড়িয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতে বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতেই হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য আবশ্যিকভাবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার থাকতে হবে এবং সেখানে প্রয়োজনীয় বই, গবেষণাপত্র ইত্যাদি রাখা এবং তার জন্যও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতে সামান্য যে বরাদ্দ, সেটিও বৈধ ও অবৈধ দুর্নীতির শিকার (বৈধ দুর্নীতি বলতে শিক্ষা খাতের ব্যয় প্রকল্প পরিচালকের গাড়ির পেট্রোল ক্রয়ে ব্যবহৃত হওয়াকে বোঝানো হচ্ছে)! শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং সমগ্র বরাদ্দকে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে ব্যয় করতে পারার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার শিক্ষা খাতে ব্যয় কোথায়, কীভাবে করতে হবে তার দায়িত্ব সদ্য স্বরাষ্ট্র বা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে আসা প্রশাসন ক্যাডারদের হাতে দেওয়া ঠিক হবে না।
সবশেষে বলব, শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত অর্থায়ন এই মুহূর্তে সময়ের দাবি। এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রগতির ধারাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেখা গেছে যে, দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা এবং শিক্ষার ক্রমাগত বেসরকারিকরণের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ গত কয়েক বছরে বেশ কমেছে। এখন শিক্ষা খাতে তাদের বরাদ্দ জিডিপির ৫.৭%। যুক্তরাজ্যেও একই কারণে এ বরাদ্দের পরিমাণ বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৫.৩%-এ। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করে, তা বাংলাদেশের প্রায় ৫০ গুণেরও অধিক। অথচ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমে যাওয়ায় এই দেশগুলোতে ইদানীং প্রায়ই ছাত্র বিক্ষোভ ভয়াবহভাবে দানা বাঁধছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের বিক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি আমরা, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। অতএব, এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণে এবং জাতীয়ভাবে টেকসই উন্নয়নের ধারাকে নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত হবে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং তার প্রতিফলন এই আসন্ন জাতীয় বাজেটেই পড়বে বলে আশা করছি।

লেখকবৃন্দ :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন
বর্ষের শিক্ষার্থী
 

No comments

Powered by Blogger.