উচ্চ আদালত-রায় নিয়ে লেখালেখি বন্ধ হোক by ইমরানুল কবির

‘নীরব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দুদক’ মূলে মিজানুর রহমান খান ও পরবর্তী সময়ে আইনজীবী খোরশেদ আলম খানের প্রতিক্রিয়া দেখে যারপরনাই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছি। এটা কেমন কথা যে মিজানুর রহমান খান মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায়কে পছন্দ হলে তাকে মাইলফলক রায় বলে অভিনন্দিত করছেন, অপছন্দ হলে ‘মহাবিপর্যয়’ বলে বাতিল করে দিচ্ছেন।


বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগের পর আর কোনো আদালত এই ধরাভূমিতে নেই। অথচ মিজানুর রহমান খান ও খোরশেদ আলম খান সংবাদপত্রকে একটি বিকল্প আদালত বানিয়ে ছেড়েছেন।
এখানে উল্লেখ্য, মহীউদ্দীন খান আলমগীর মামলায় আপিল বিভাগ আদালতে বসে শুধু লিভ গ্রান্ট না হওয়ার আদেশ দিয়েছেন, কিন্তু কী কী গ্রাউন্ডে ‘লিভ’ দেওয়া হয়নি, তার পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো আসেনি। সংগত কারণেই বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের আদালত দুদকসংক্রান্ত মামলাগুলোর রায় ও শুনানি এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন, যাতে আপিল বিভাগের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী মামলাগুলোর রায় হতে পারে। অথচ মিজানুর রহমান খান ও খোরশেদ আলম খান জেনেশুনেই এই মামলা নিয়ে কলাম লিখতে বসে গেছেন। বিস্মিত হই এই দেখে যে, কোনো কোনো মামলার রেফারেন্সকে তিনি অপ্রাসঙ্গিক, কোনোটিকে ‘যথার্থ’, ‘যুগান্তকারী’, ‘মহাবিপর্যয়কারী’ হিসেবে অভিমত দিয়েছেন বা তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করার প্রয়াস নিয়েছেন। তার মানে কি এখন আপিল বিভাগের সম্মানিত বিচারপতিদের সংবাদপত্রে কলাম লিখে তাঁদের রায় ব্যাখ্যা করতে হবে? মিজানুর রহমান খান যদি এতই আইনবিশেষজ্ঞ হয়ে যান, তবে কেন আইনজীবী হিসেবে ‘এনরোল্ড’ হয়ে তাঁর বক্তব্য আদালতে পেশ করছেন না? লক্ষ করবেন, আমি কিন্তু ‘লিগাল সাইটেশন’গুলো যথার্থ আছে কি না সে বক্তব্যে যাচ্ছি না। কেননা, আইনি যুক্তিতর্ক সব সময় আদালতে পেশ করাই শ্রেয়।
আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, আইনি প্রথাগতভাবে বিচারকেরা তাঁদের বিরুদ্ধে বা তাঁদের রায়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা সমালোচনার জবাব সংবাদপত্র বা অন্য কোনো মিডিয়ার মাধ্যমে দিতে পারেন না এবং তা শোভনও নয়। এ জন্যই প্রথাগতভাবে আদালতের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে তাঁকে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে হবে এবং সেখানেই একমাত্র তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে আপনি সেই রায়ের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বা মিডিয়ায় জনমত গঠন করতে পারেন না। আদালতকে তো আমরা বাগ্যুদ্ধে নামাতে পারি না। আদালত কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার নন যে আপনি এর কোনো রায়কে ‘অভিনন্দিত’ করবেন আবার কোনো রায়ের নিন্দা জানাবেন। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি মিডিয়া সেন্টার খুলে সংবাদপত্রের কলাম লেখকদের আদালতে জজ সাহেবদের হাজির হতে হবে।
মিজানুর রহমান খান আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কি না আমি জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি যে আইন নিয়ে তাঁর আগ্রহ রয়েছে এবং বিভিন্ন সময় ডিএলআর, এআরআইসহ অন্যান্য ‘ল রিপোর্ট’ তিনি পড়েন এবং নিজে আইনজীবী না হওয়ায় ‘বার কাউন্সিল’ বা আইনজীবীদের স্বপ্রণোদিত (Self imposed) কন্ডাক্ট রুলস সম্পর্কে তিনি অবহিত নন এবং হয়তো বা সেখানে কী আছে, তিনি জানেন না। তা না হলে যে মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো লেখা হয়নি, সে মামলার রায় নিয়ে তিনি কখনো কলাম লিখতেন না। কিন্তু খোরশেদ আলম খান কেন এমনটা করলেন? তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী। তিনি মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন, ‘অর্জন কী বিসর্জন হল?’ তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগেই বলছেন, সাংসদ মোল্লার রায় আর ম. খান আলমগীর মামলা দুটি সাংঘর্ষিক হবে এবং অধস্তন কোর্ট কোন রায় অনুসরণ করবেন, সে প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর মামলা আপিল বিভাগে চলাকালে সেখানে দুদক আইনজীবী হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি কি এসব প্রশ্ন সেখানে তুলেছিলেন? যদি তুলে থাকেন তবে কি তাঁর উদ্বেগ আদালতের রায়ে প্রতিফলিত হবে না বলে তিনি মনে করেন? তিনি যদি তাঁর উদ্বেগের কথা আদালতে বলে থাকেন, তবে তিনি কেন পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই সংবাদপত্রে লিখতে গেলেন? তিনি ও মিজানুর রহমান খান কেন যুক্তভাবে তারেক রহমান ও গিয়াসউদ্দিন মামুনের নতুন মামলাগুলোর রেফারেন্স দিতে গেলেন? এটা কি সরকারকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করা নয় যে দেখুন, আপনারা যদি কিছু না করেন, তবে তারেক-মামুন ছাড়া পেয়ে যাবেন।
বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের আদালত যেভাবে দুদকসংক্রান্ত মামলাগুলোর শুনানি স্থগিত করেছেন, সেভাবে মহীউদ্দীন খান আলমগীর মামলার রায়ের আলোকে ‘Sanction’ নিতে দুদকের কোনো বাধা তো নেই। সে ক্ষেত্রে জনাব খানদের আচরণকে আমরা কী বলতে পারি? দুদকের সব মামলা শেষ হয়ে যাবে—এই ধুয়া তুলে উচ্চ আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টার আগে পাঠক তো খোরশেদ সাহেবদের কাছে এ কথা জানতে চাইতে পারে যে, এত টাকা আপনাদের পেছনে খরচ করা হলো, এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলো, তবে দুদককে মিজান খানের ভাষায় ‘গোডাউন’ বানালেন কেন?
মিজানুর রহমান খান অবগত আছেন কি না জানি না, দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা এবং তার একটি স্বাধীন আইনজীবী দল আছে। অতএব অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস দুদকের আইনজীবীদের সঙ্গে একমত হবে, এমন কোনো কথা নেই। জরুরি অবস্থাকালে সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থেকে তখনকার দুদক, টাস্কফোর্স স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যা ইচ্ছা তা করেছে, অথচ যেখানে আসলেই মামলা হয়, সেখানে মামলা দায়ের করেনি। তৎকালীন দুদকের স্বেচ্ছাচারিতার দায়ভার নির্বাচিত সরকার ও তার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস কেন নেবে? এমনকি বর্তমান দুদুকেরও তা নেওয়া উচিত হবে না। আমি কখনো বলি না, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁরা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা। তাই বলে ওই ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে গিয়ে আইন ভাঙা হলে তা হবে আরেকটা বেআইনি কাজ।
বার কাউন্সিল কর্তৃক আইনজীবী সনদ পাওয়া সবাই কিন্তু কোর্ট প্র্যাকটিস করেন না। কেউ কেউ চেম্বার প্র্যাকটিস ও ইন হাউস লইয়ার হিসেবে কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে আইনবিষয়ক কলাম লেখকদের জন্য বার কাউন্সিলের সনদ থাকা অপরিহার্য হওয়া উচিত। বার কাউন্সিল কলাম লেখার ক্ষেত্রে কিছু গাইডলাইন দিতে পারে। আইনবিষয়ক একাডেমিক বইয়েও প্রায়ই আদালতের রায়ের সমালোচনা করা হয়, যা কিন্তু পুরোপুরি একাডেমিক সমালোচনা; সেহেতু আইনি দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মিজানুর রহমান খান ও খোরশেদ খানের কলামকে কোনোক্রমে একাডেমিক আলোচনা বলা যাবে না। এধরণের আলোচনা যদি অব্যাহত থাকে তবে তা বেঞ্চ ও বার দুই পক্ষের জন্যই হবে দুর্ভাগ্যজনক।
ইমরানুল কবির: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, ব্যারিস্টার এট-ল।

No comments

Powered by Blogger.