অপটিক্যাল ফাইবার লাইনের ২০০ কোটি টাকার কাজ-বেপরোয়া পদক্ষেপ বিটিসিএলের by টিপু সুলতান

রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার লাইন স্থাপনের কাজ নিয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত রিভিউ প্যানেলের রায়, বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করেছে। সর্বশেষ বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং সেখানেও বিটিসিএলের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছে।


অভিযোগ উঠেছে, টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন এই কাজের (লট-বি) প্রাক্কলিত ব্যয় ৯০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২০০ কোটি টাকা করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দিতে এই প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়েছে বিটিসিএল। রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থার তদন্তেও এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এটা করতে গিয়ে বিটিসিএলে এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে প্রাকযোগ্যতা যাচাই পর্যায়েই বাদ দেওয়া হয়। এ কাজের জন্য আগ্রহী পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরও দুটি কোম্পানি বাদ পড়ায় দরপত্রে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর এই দুটি প্রতিষ্ঠানেরই স্থানীয় সাহায্যকারী (এজেন্ট) একই মহল।
বিটিসিএলের এ-সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এক হাজার ৪৩১ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার লাইন ও ১১টি মাইক্রোওয়েব লিঙ্ক বসানোর জন্য ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদ (একনেক) অনুমোদন দেয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এই কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার (১১১ কোটি টাকা)। পরের বছর এই ব্যয় ১১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার (৯১ কোটি ৭২ লাখ) বাড়িয়ে ২৪ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা) করা হয়। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্প পরিচালক বর্ধিত এই প্রাক্কলন অনুমোদনের জন্য পাঠান।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার মণ্ডল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, প্রাক্কলন বাড়িয়েছেন বিদেশি পরামর্শক। বিটিসিএল এতে সম্পৃক্ত নয়।
প্রাক্কলন বাড়ানোর এই প্রস্তাব প্রকল্পের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটিকে (কো-অর্ডিনেশন কমিটি) সঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে কি না এবং সমন্বয়ক কমিটি একে বাস্তবসম্মত মনে করে কি না, তা জানতে চেয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর দাপ্তরিক আদেশ দেন বিটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) নাদির শাহ কোরেশি। এরপর নাদির শাহ কোরেশিকে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়।
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বিটিসিএলের তৎকালীন সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আজিজুল ইসলাম (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত এমডি) নথিতে লেখেন, এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। সমন্বয় কমিটি একে বাস্তবসম্মত বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাই এর ওপর ভিত্তি করে জমা পড়া দরপত্র খোলা ঠিক হবে না।
এসব কিছু উপেক্ষা করে বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু সাঈদ খান প্রকল্প পরিচালকের পরামর্শে দরপত্র খোলার জন্য বর্ধিত প্রাক্কলন অনুমোদন দেন। জমা পড়া দুটি প্রতিষ্ঠানের শুধু কারিগরি প্রস্তাব খোলা হয় চলতি বছর ১৬ জানুয়ারি এবং তা উপ-মূল্যায়ন কমিটিতে পাঠানো হয়। আর্থিক দরপ্রস্তাব তখন খোলা হয়নি।
রিভিউ প্যানেলের রায় ও মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষিত: প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ে বাদ পড়া তুরস্কের কোম্পানি নাটাস তাদের অন্যায়ভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে দাবি করে ক্রয়সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী সরকার গঠিত রিভিউ প্যানেলের শরণাপন্ন হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে রিভিউ প্যানেল গত ৬ মার্চ নাটাসকে এই দরপত্রের জন্য প্রাকযোগ্য ঘোষণা করে এবং সে অনুযায়ী বিটিসিএলকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
রিভিউ প্যানেলের এই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও গত ১৮ মার্চ বিটিসিএলকে নির্দেশ দেয়। ২১ মার্চ বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সভায় মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশ তথা রিভিউ প্যানেলের রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় সদস্যরা বিটিসিএলের ‘অসংগত কার্য’ বিষয়ে অনুসন্ধান করে পরিচালনা পর্ষদকে জানানোর নির্দেশ দেন। ৪ এপ্রিল পর্ষদের ৭২তম সভায় পূর্ববর্তী সভার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে।
কিন্তু বিটিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব আমলে না নিয়ে ৩ মে তাঁদের মূল্যায়নে যোগ্য দুটি কোম্পানির আর্থিক দরপ্রস্তাব খোলার ব্যবস্থা করেন। তাতে দেখা যায়, বর্ধিত প্রাক্কলিত ব্যয়ের কাছাকাছি দরপ্রস্তাব করেছে একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর কারিগরি উপ-মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়কের কাছে সব দরপত্র পাঠানো হয়। কিন্তু কমিটির আহ্বায়ক ৩ মে ছুটিতে বিদেশে চলে যান। ২৪ এপ্রিল তাঁর ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল।
অব্যাহতি চাইলেন মূল্যায়ন কমিটির সদস্য: সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ অবস্থায় তিন সদস্যের উপকমিটির বাকি দুই সদস্যের একজন সাইদুল ইসলাম ১৬ মে পরিচালককে (সংগ্রহ) লিখিতভাবে জানান, তিনি ১৫ মে মূল্যায়নসংক্রান্ত চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি এই কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন।
গোয়েন্দা অনুসন্ধান: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান করে গত মাসে প্রতিবেদন দিয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিটিসিএলে পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়, বিটিসিএলের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরামর্শক ও একটি অসাধু চক্র অতি মূল্যায়িত প্রাক্কলন তৈরি করে সরকারের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার পরিকল্পনা করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টেলিফোনে কথোপকথন থেকে বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া ও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অবশ্য বিটিসিএলের সাবেক এমডি আবু সাঈদ খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, পরস্পর যোগসাজশে অতি মূল্যায়িত অর্থ আত্মসাতের আয়োজনসংক্রান্ত অভিযোগ ঠিক নয়।
প্রসঙ্গত, আবু সাঈদ খানের কার্যকালেই এই দরপত্রের বেশির ভাগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কয়েক মাস আগে তাঁকে বিটিসিএল থেকে টেলিফোন শিল্প সংস্থায় বদলি করা হয়।
তথ্য গোপন করে হাইকোর্টে রিট: আর্থিক দরপ্রস্তাব খোলার খবর পেয়ে ৬ মে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে রিট আবেদন করে নাটাস। শুনানি নিয়ে ৯ মে আদালত সাত দিনের মধ্যে রিভিউ কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই দরপত্রসংক্রান্ত কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত।
এদিকে বিটিসিএল ৭ মে হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে গিয়ে নাটাসের পক্ষে দেওয়া রিভিউ প্যানেলের সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করার জন্য রিট আবেদন করে। রিটে ২১ মার্চের পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত, ৪ এপ্রিলের সভায় নিশ্চিতকরণ, ১৮ মার্চের মন্ত্রণালয়ের আদেশ ও ৩ মে আর্থিক প্রস্তাব খোলার তথ্য গোপন রাখা হয়। পাশাপাশি হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ নাটাসের করা রিটের প্রসঙ্গ চেপে যাওয়া হয়।
বিটিসিএলের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বেঞ্চ রিভিউ প্যানেলের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এ খবর জানতে পেরে নাটাস ওই আদালতকে তথ্য গোপনের বিষয় অবহিত করে। শুনানি শেষে ২২ মে আদালত আগের স্থগিতাদেশ পরিবর্তন করে স্থিতাবস্থার নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে ৬ জুন চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য আছে।
অপটিক্যাল ফাইবার কী
অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের মাধ্যমে উন্নততর লেজার প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে একই সঙ্গে অনেক টেলিফোন ও ইন্টারনেটের তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশির ভাগ জেলা সদর, উপজেলা ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, প্রতিরক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত।
অবিশষ্ট উপজেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে সব টেলি ও ইন্টারনেট যোগাযোগ ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অপটিক্যাল লিংকের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে সাবমারিন কেবলে যুক্ত হয়।

No comments

Powered by Blogger.