'সবুজ অর্থনীতি :তুমি কি সেখানে আছো?' by মাহবুবা নাসরীন

এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'সবুজ অর্থনীতি : তুমি কি সেখানে আছো?' প্রশ্নটা অন্যভাবে করা সম্ভব_ 'সবুজ অর্থনীতির আলোচনায় তোমাকে কি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে?' তুমি কে? তুমি গাঁয়ের, তুমি শহরের। তুমি শিশু, তুমি কিশোর অথবা যুবা।


তুমি যদি মানুষ প্রজাতির হও তবে জন্মের পর থেকে যে পরিচয়টা তোমার সামনে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে তুমি নারী অথবা পুরুষ। বাংলাদেশে নানা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে অর্থনীতির চাকা সামনে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় আর এসবের প্রভাব নারী-পুরুষ সবার ওপরে সমানভাবে পড়ে না। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়ে নারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথবা পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে বিপর্যস্ত হচ্ছে, এই চিত্রই তুলে ধরা হয়। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রতিকূল পরিবেশে সম্পদ ও সংসার টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে নারীর অবদানই অগ্রগণ্য। কিন্তু এ বিষয়গুলো আলোচনায় উহ্যই থেকে যায় অথবা গুরুত্ব পায় না। আর তাই অর্থনীতিতে, বাজেটে, সবুজ রক্ষায় নারী প্রসঙ্গ মূলধারায় আলোচিত হয় না।
চার দশক ধরে নারী, পরিবেশ এবং উন্নয়ন ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় নারী, পরিবেশ ও উন্নয়নের আলোচনা এসেছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, যেমন চিপকো আন্দোলনের আলোকে। সবুজ অর্থনীতির আলোচনায় বনায়ন, কৃষি, সেচ, পানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো থাকে সর্বাগ্রে। গ্রামীণ ও শহুরে নারীর জীবনে জ্বালানি, খাদ্য, পানি, পশুখাদ্য এসবের সংকট ও এসবের দূষণ, যেমন_ বায়ু, পানি, মাটি, রাসায়নিক ও শব্দদূষণ এসব বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উন্নয়নশীল বিশ্বে নারীদের দেখা হয় পরিবেশ ব্যবস্থাপক হিসেবে। কারণ পরিবেশ সংক্রান্ত জ্ঞান তাদেরই বেশি এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা অপেক্ষাকৃত মিতব্যয়ী। ভারতের চিপকো আন্দোলন, কেনিয়ার মৈথিয়া দল ও সবুজ বেষ্টনী আন্দোলন অথবা বাংলাদেশের নারীদের দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কীভাবে পরিবেশকে সংরক্ষণ করছে তার প্রভূত উদাহরণ রয়েছে। তবুও উন্নয়নের আলোচনায় অর্থনীতি, প্রতিকূলতাকে জয় করে দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করা নারীর অবদান লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যায়। বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা বা দুর্যোগে পরিবার রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালনকারী সংক্রান্ত আলোচনা মধ্য নব্বই থেকে গবেষণায় প্রমাণিত হলেও তাদের নাজুক হিসেবে দেখানোর প্রবণতাই বেশি। এ সত্যটি সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে জাতিসংঘের 'আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কৌশল' (আইএসডিআর)-এর 'হিউগো ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যাকশন'-এর অগ্রগতি পর্যালোচনায় এশিয়া অঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত প্রতিবেদনে। এ বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০১২ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক ঝুঁকি হ্রাস দিবসের স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে 'নারী ও বালিকা দুর্যোগ প্রতিরোধে নীরব শক্তি'। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি স্টাডিজ (সিডিভিএস) গত ২২ মে একটি গোলটেবিল বৈঠকেরও আয়োজন করে। বৈঠকে গবেষক, সরকারি, বেসরকারি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়নের অংশীদার সংস্থা, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নারীরা নাজুক নয় বরং উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা, দুর্যোগকালীন সংকট নিরসনে প্রধান শক্তি। তাই এই শক্তিকে নীরবে না রেখে সরকারি পরিকল্পনা, বাজেট ও উন্নয়নের সার্বিক আলোচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। ৫ জুন অনুূষ্ঠিতব্য বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য 'সবুজ অর্থনীতি : তুমি কি সেখানে আছো?' সেমিনারেও সিডিভিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ পরিবেশ রক্ষা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি নিরসনে নারীর অবদান তুলে ধরে তার সক্রিয় সরব উপস্থিতি হিসেবে দেখানোর প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

স ড. মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক ও সমন্বয়ক সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি স্টাডিজ (সিডিভিএস), সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা
 

No comments

Powered by Blogger.