চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-উপাচার্যের দায়িত্বহীনতা ও সরকারের খেসারত

কিছুদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবস্থা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো দেশের অনেকের মতো আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে, ভাবিয়ে তুলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা কারও কাম্য নয়।


আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কিছু ফি বৃদ্ধি করেছিল। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে এবং বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা একাধিকবার উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তার পর তারা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন। একপর্যায়ে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দেয় (কর্তৃপক্ষের ভাষায়)। আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। এরপর পুলিশের মারমুখী আচরণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকা শিক্ষার্থীদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ৩ আগস্টের পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন হলের পাঁচ শতাধিক ছাত্রী ২ আগস্ট ক্যাম্পাসে সমবেত হলে চারদিক থেকে ঘিরে পুরুষ-পুলিশ তাঁদের ওপর নির্বিচারে লাঠিপেটা করে, দুই শতাধিক কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে হলে হলে ঢুকে নির্বিচারে লাঠিপেটা করে। এমনকি শিক্ষকদের ওপরও তারা চড়াও হয়; আহত ছাত্রীদেরও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা দেয়। দেখা গেল, প্রশাসনের চোখের সামনে চবিতে পুলিশ বিক্ষোভ দমনে যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের তাণ্ডবের সময় অথবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমি দখলের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট ঘটনায় পুলিশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ধরনের পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। যদিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করে পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে নিজ দলের কর্মীদের নিচে ফেলে দেওয়ার মতো হিংস্র ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কমিটিকে ৪৫ দিন সময় দিয়েছে!
কিন্তু এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হয় না যে ৪৫ দিন সময় দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীদের আড়াল করা। অর্থাৎ জাবিতে প্রশাসন সরকারি দলের ছাত্র-কর্মীদের রক্ষার চেষ্টা করেছে আর চবি প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ‘শিক্ষা দিতে’ দ্রুত অ্যাকশনে গেছে। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে আমাদের মনে হয়েছে আমরা কোনো পুলিশ কর্মকর্তার দম্ভোক্তি শুনছি। কারণ, উপাচার্যের বক্তব্যে অভিভাবকসুলভ দায়িত্বশীলতার কোনো ছাপ ছিল না, বরং ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি। অন্যদিকে এ ধরনের একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার পরও পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহির আওতায় আনার ঘোষণা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে শোনা যায়নি। এ ঘটনার প্রতিবাদ আসেনি আমাদের নাগরিক সমাজ, নারী আন্দোলন কিংবা মানবাধিকার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেও।
বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং ক্যাম্পাসে সংঘটিত নানা অনাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নতুন নয়, একইভাবে এ ধরনের আন্দোলন দমনে আলোচনার উদ্যোগের থেকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের কৌশলও পুরোনো। তবে প্রশাসন কিংবা পুলিশের এ আচরণ যে বিক্ষোভ দমনের থেকে তা উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে, তা নিকট অতীত থেকেও আমরা জানতে পারি। আমরা যেকোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক বিক্ষোভের বিরোধী। একই সঙ্গে এ প্রশ্নটিও করতে চাই, সামান্য ফি বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে? একুশ শতকের উপযোগী আধুনিক জাতি গঠনে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। উচ্চশিক্ষার পুরো অর্থায়ন রাষ্ট্র করবে কি না, তা নিয়েও আমরা এখানে আলোচনা করব না। তবে এ কথাটি অবশ্যই বলব, একজন ঋণখেলাপির শত কোটি টাকা মওকুফ করলে রাষ্ট্র কতটুকু উপকৃত হয় জানি না, তবে শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্র একটি টাকা বিনিয়োগ করলে তা হাজার গুণ ফল এনে দেয়; যা সমগ্র জাতি অনন্তকাল ধরে ভোগ করতে পারে। সম্প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের আরোপিত ভ্যাট নিয়ে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ায় সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া সরকারকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় সহায়তা করেছে। সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মতো অনড় অবস্থান নেয়নি। সুতরাং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন আলোচনার পথে না গিয়ে, নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য আর ধমক দিয়ে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে, পুলিশ লেলিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে, শিক্ষার্থীদের সেশনজটের মুখে ঠেলে দিয়ে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিল, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। শেষপর্যন্ত এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে হয় সরকারকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের সামনে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট ওপেন’ করে দিল।
আমরা এর আগে দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে রাতের বেলায় পুরুষ-পুলিশ প্রবেশ করিয়ে ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছিল, যখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ওই সময়ে সেই অনাচারের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশের প্রায় সব ক্যাম্পাস। আজকের ক্ষমতাসীন দল ও তার প্রধান সেই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছিলেন। তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য ও প্রক্টরকে সরকার অপসারণ করে আন্দোলনকারীদের আংশিক দাবি পূরণ করেছিল। সেই উপাচার্য ও প্রক্টর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাভরে পাঠ গ্রহণ করছেন। কিন্তু সেই ঘটনা বিএনপি সরকারের ইমেজের ওপর যে কালো দাগ এঁকে দিয়েছে, তা কি কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে? ২ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর যে বীভৎসতা নিয়ে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা কি শামসুন্নাহার হলের সেই ঘটনা থেকে খুব বেশি পৃথক? কিংবা এ ঘটনা কি বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিতে কালির দাগ দেয়নি? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাঁধে এ ঘটনার দায়ভার যতটুক না বর্তাবে, তার থেকে বেশি দায় নিতে হবে সরকারকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সত্যটি হয়তো এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি। ২ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওই সমাবেশে গ্রামের সাধারণ অভিভাবকদের সন্তানেরা ছিলেন। আর এই অভিভাবকেরাই কিন্তু ক্ষমতা আর গদি পাল্টে দেন; উপাচার্য কিংবা পুলিশ কর্মকর্তারা নন।
লেখকেরা মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.