লোভে যেন ধ্বংস না হয় পরিবেশ by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

পরিবেশ অধিদফতরের এনফোর্সমেন্ট টিম প্রায় প্রতিদিনই সারাদেশে পরিবেশ ধ্বংসকারী মর্মান্তিক ঘটনা উদ্ঘাটন করছে এবং পরিবেশ ধ্বংসে জড়িতদের আইনের আওতায় আনছে। নির্মম বাস্তবতা হলো, দেশের কোনো এলাকা বা অঞ্চলে দূষণমুক্ত পরিবেশ পায়নি পরিবেশ অধিদফতরের এনফোর্সমেন্ট টিম।


শিক্ষিত ও সচেতন উদ্যোক্তারাও পরিবেশকে দেখেন চরম অবহেলার চোখে। বাংলাদেশে শিল্প সেক্টরে চলছে সর্বগ্রাসী দূষণ। অনেক কারখানা মালিক খুব স্বল্প ব্যয়ে ইটিপি বসিয়েছেন। অনেকে আবার অদক্ষ ও অযোগ্য প্রকৌশলী দিয়ে ইটিপি বসিয়েছেন, যে বিষয়ে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। শিল্প-মালিক, উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, পরামর্শক, কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, পরিবেশ অধিদফতরের টিম কখনও পদার্পণ করবে না কিংবা করলেও কারও শাস্তি হবে না। এর যথেষ্ট ভিত্তি আছে। কারণ শুধু গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে গত ৭-১০ বছরে পরিবেশ অধিদফতর আদৌ পরিদর্শন করেনি, এমন কারখানার সংখ্যা সহস্রাধিক। এভাবেই পরিবেশ আইনের প্রয়োগ ছিল অকার্যকর, যা দূষণের পথকে উন্মুক্ত করেছে অবলীলায়। এভাবেই বিষাক্ত বর্জ্যের স্রোতে ভেসে গেছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, তুরাগ ও বালু নদ এবং গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে অগণিত দূষণকারী ইটভাটা নিঃসৃত কার্বনের উত্তপ্ত হাওয়া। পরিবেশবাদীরা এসব ঘটনায় সরব থাকলেও সাধারণ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিবেশ অধিদফতরের সাম্প্রতিক এনফোর্সমেন্ট অভিযানের প্রভাবে এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের গতি কমেছে। ক্রমে প্রশমিত হচ্ছে মানুষের যন্ত্রণা। দূষণের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সমান্তরালে মালিক-শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের পরিবেশসচেতন করা হচ্ছে এবং প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এনফোর্সমেন্ট অভিযানের মূল লক্ষ্য_ পরিবেশগত ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় এনে তার ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ আদায় করা, যা কখনও আগে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। যদিও পরিবেশের ক্ষতির তুলনায় এ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তবে এ কাজে সাফল্যের পূর্বশর্ত ব্যবসায়িক সততা ও নৈতিকতা। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সততা-নৈতিকতা না থাকলে পরিবেশ অধিদফতরের একার পক্ষে পরিবেশ ধ্বংসের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দুরূহ। বছরের পর বছর পরিবেশ দূষণের যে ঘটনা ঘটেছে, তা কোনো অবহেলা নয়, অমার্জনীয় অপরাধ। এ অপরাধ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের, পানিসম্পদ বিনষ্টের, বায়ুমণ্ডল দূষণের এবং মানুষের জীবননাশের। রাসায়নিক, পারমাণবিক বা জীবাণু অস্ত্রের মতোই মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে পরিবেশ দূষণের ঘটনা। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পরিবেশ অধিদফতরের প্রত্যাশা_ এ মহৎ দিনটিতে পরিবেশ দূষণ বা পরিবেশের অবক্ষয়ের ঘটনা যেন বন্ধ থাকে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, উদ্যোক্তা, কর্মজীবী, শ্রমজীবীসহ সর্বস্তরের নাগরিকরা পরিবেশ দূষণ থেকে বিরত থাকবেন। ফুটপাতে সিগারেটের উচ্ছিস্ট ফেলা, বর্জ্য ফেলে নালা-নর্দমা ভরাট, টয়লেট অপরিচ্ছন্ন রাখা, হোটেল রেস্টুরেন্টকে অস্বাস্থ্যকর রাখা, শব্দদূষণে জীবন বিপন্ন করা, ইটভাটার ধোঁয়ায় স্বাস্থ্যহানি ঘটানো, অশোধিত বর্জ্যে নদীর প্রতিবেশ ধ্বংস করা, আবাসন প্রকল্পের নামে জলাশয় ভরাট করা, শিল্পায়নের নামে নদী-দখল_ এসব ঘটনা বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত হয়ে পরিবেশের জন্য প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠছে। ৫ জুন বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী ও মেঘনায় বর্জ্যের স্রোত বন্ধ হোক এবং এদিন থেকেই শুরু হোক চিরদিনের জন্য পরিবেশ দূষণ বন্ধের কঠিন শপথ। পরিবেশ রক্ষার এ অভিযাত্রায় পরিবেশ অধিদফতর নয়, শিল্পোদ্যোক্তা-মালিকরাই নিশ্চিত করবেন, তাদের কারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার সঠিকভাবে চলছে। তখন পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষে এনফোর্সমেন্ট অভিযানের আর প্রয়োজন হবে না। সততা-শুদ্ধতায় ফিরে আসুক সবার কাঙ্ক্ষিত দূষণমুক্ত বাংলাদেশ এবং চিরসবুজ বাংলাদেশ। অর্থ লোভের কাছে যেন ধ্বংস না হয় পরিবেশ। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার কমাতে হবে, ব্যবসায়িক নৈতিকতা বাড়াতে হবে। জীবনের প্রাচুর্যতা কমাতে হবে। দূষণের অভিশাপ থেকে বাঁচতে হবে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার মুনাফার চেয়ে বেশি মূল্যবান_ ৫ জুন আমাদের চিন্তায় ও মননে এ বিশ্বাস ফিরে আসুক।

সমোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী :পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদফতর
mmunirc@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.