সমকালীন প্রসঙ্গ-যে দুর্নীতির মামলার নিষ্পত্তি হয়নি by বদরুদ্দীন উমর

ৃযদি এপিএস ৭০ লাখ টাকার উৎস প্রকাশ করতে দুদকের কাছে অস্বীকৃত হন, তাহলে দুদকের পরবর্তী কর্তব্য হবে তাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা এবং পুলিশের উচিত হবে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। অনেক নিরীহ লোককে পুলিশ ও র‌্যাব রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে।


সে ক্ষেত্রে এপিএসের মতো একজন 'দুর্নীতিবাজ'কে যদি দুদক পুলিশের হাতে তুলে না দেয় এবং পুলিশ যদি তাকে রিমান্ডে না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে এ দেশে ইতিমধ্যেই দুর্নীতির রাজত্ব প্রশাসন ক্ষেত্রে সার্বভৌম হয়েছে

অধস্তন কর্মচারীদের দিয়ে গঠিত তার নিজের দুর্নীতি বিষয়ক তদন্ত করিয়ে নিজেকে খালাস দেখিয়ে সুরঞ্জিত বাবু এখন আবার রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছেন। বাংলাদেশের অবস্থা এমনই করুণ যে, ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতার এসব করতে লজ্জা-শরম অথবা অন্য কোনো প্রকার অসুবিধা হয় না। দুর্নীতি ইত্যাদি ধরা পড়লে তাদের মতো লোকেরা লজ্জা-শরম একেবারেই পান না বা তাদের কোনো প্রকার অসুবিধাই হয় না, এটা অবশ্য ষোলোআনা ঠিক নয়। কারণ তারা বিপাকে পড়লে প্রথম কয়েকদিন মুখ লুকিয়ে থাকেন। ছোটখাটো অসুখ থেকে সেরে ওঠার মতো করে তারা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাদের কিছুই হয়নি!
দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের কাছে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস, রেলের জেনারেল ম্যানেজার ও ঢাকা বিভাগীয় রেলের নিরাপত্তা কর্মকর্তা সপরিবারে নিজেদের সম্পদের হিসাব দাখিল করেছেন। এভাবে দুর্নীতিবাজরা নিজেদের সম্পদের যে হিসাব সরকারিভাবে দাখিল করেন সেটা যে তাদের প্রকৃত সম্পদের সামান্য একটা অংশমাত্র এটা বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিবাজ অধ্যুষিত আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এক সাধারণ ও পরিচিত ব্যাপার। উপরোক্ত তিনজন যে ধাতুর দুর্নীতিবাজ তাতে এদিক দিয়ে তাদের অবস্থা ব্যতিক্রমী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের সম্পদের যে হিসাব তারা দিয়েছেন (ডেইলি স্টার, ৪.৬.২০১২) তার থেকেও এটা পরিষ্কার যে, আয়ের তুলনায় তাদের প্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণ পাহাড়তুল্য। এর মধ্যে এপিএসের সম্পদের হিসাবটাই সব থেকে চোখে পড়ার মতো। কারণ, এর পরিমাণ তো বেশি বটেই। উপরোক্ত ব্যাংকে জমা ৯১ লাখ টাকার মধ্যে গাড়িতে যে ৭০ লাখ টাকা ধরা পড়েছিল তার উৎস নির্দেশ করতে তিনি পারেননি। শুধু তাই নয়, সেটা করতে তিনি অস্বীকার করেছেন। রেলের এই কর্মচারীরা যে তাদের সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের খুবই অনুগত এবং পেয়ারের লোক এতে সন্দেহ নেই। শোনা যাচ্ছে, উপরোক্ত তিন রেল কর্মচারীর সম্পদের বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় এপিএসের গাড়িতে পাওয়া ৭০ লাখ টাকার উৎসই হওয়া দরকার প্রধান জানার বিষয়। এই উৎস নিয়ে এপিএসকে উল্টেপাল্টে জেরা করলে শুধু যে সেই টাকার উৎসই ধরা পড়বে তাই নয়, সে টাকা কোথা থেকে এসে কোথায় যাচ্ছিল সে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে জানা যাবে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা অবশ্যই বলা দরকার। যদি এপিএস ৭০ লাখ টাকার উৎস প্রকাশ করতে দুদকের কাছে অস্বীকৃত হন, তাহলে দুদকের পরবর্তী কর্তব্য হবে তাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা এবং পুলিশের উচিত হবে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। অনেক নিরীহ লোককে পুলিশ ও র‌্যাব রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। সে ক্ষেত্রে এপিএসের মতো একজন 'দুর্নীতিবাজ'কে যদি দুদক পুলিশের হাতে তুলে না দেয় এবং পুলিশ যদি তাকে রিমান্ডে না নেয়, তাহলে বুঝতে হবে এ দেশে ইতিমধ্যেই দুর্নীতির রাজত্ব প্রশাসন ক্ষেত্রে সার্বভৌম হয়েছে।
এবার আসা দরকার এই মামলার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান রেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তদন্ত শেষ করার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এপিএসের ড্রাইভার আলী আজমকে জেরা করার বা তার সাক্ষ্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ অন্য সকলের সাক্ষ্যই নেওয়া হয়েছে! এই প্রধান সাক্ষীরা কারা? তারা হলো এমন ব্যক্তি যাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে! যে ড্রাইভারের কারণে পুরো বিষয়টি প্রকাশ্য হলো এবং চারদিকে সরকারি প্রশাসন ও মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হলো, সেই ড্রাইভারেরই সাক্ষ্য নাকি এতই নিষ্প্রয়োজনীয় যে, তার সামান্য প্রয়োজনও এই তথাকথিত তদন্ত কমিটি বোধ করেনি! এই প্রয়োজন তাদের বোধ না করারই কথা। কারণ সেটা করলে তাদের সাজানো মামলা লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত। কিন্তু এই কমিটির বাইরে দুদকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ড্রাইভার আজমের সাক্ষ্য ছাড়া এই মামলার তদন্ত সম্পূর্ণ হতে পারে না। খুব আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার যে, দুদকের মতো একটি সংস্থার এই বক্তব্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক রেলমন্ত্রীর দ্বারা গঠিত একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকেই আসল তদন্ত কমিটি বলে ধরে নিয়ে দুদককে প্রায় নাকচ করে বসে আছে! এই সুযোগে সুরঞ্জিত বাবু নিজেকে নির্দোষ 'প্রমাণ' করে সভা-সমিতিতে, টিভি টক শোতে এবং সাংবাদিকদের সামনে নিজের ডানা ঝাপটাচ্ছেন! এটা বলাবাহুল্য যে, সরকার দুদককে এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করানোই দুর্নীতি আজ সর্বত্র মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এপিএসের ড্রাইভার আলী আজম কোথায়? তার কী হলো? এ প্রশ্ন আমি আগেও করেছি কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সরকার তো বটেই, এমনকি সংবাদপত্র অথবা টিভিতেও এ বিষয়ে এমন এক নীরবতা পালন করা হচ্ছে যা বোধগম্য নয়। সাংবাদিকরা অন্য খুন, গুম, অপহরণ ইত্যাদি নিয়ে অনেক বড় গলায় কথা বলেন অথচ এই ধরনের এক মামলায় এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গুম হওয়া নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই কেন? বর্ডার গার্ডের হাতে আইন থাকার পর রাত ভোর হলে তিনজন রেল কর্মচারীকে তাদের চুরি করা মালামালসহ পুলিশের হাতে সোপর্দ না করে বেবাক ছেড়ে দেওয়া হলো। তারা সেখান থেকে বের হয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথচ সেই গরিব ড্রাইভার যে চুরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বর্ডার গার্ডের হেডকোয়ার্টারে গাড়ি ঢোকাল তার কোনো খবর নেই কেন?
বর্ডার গার্ড থেকে পরে বলা হয়েছে যে, ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, তার স্বামীর কোনো খবর তার কাছে নেই। তাছাড়া তিনি তাকে বলতেন, এপিএসের গাড়িতে তাকে প্রায়ই অবৈধ অর্থ বহন করতে হতো। এ জন্য তিনি যথেচ্ছ বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। এই অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ড্রাইভার আজমের খোঁজের জন্য কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না কেন, এ প্রশ্ন দেশের যে কোনো নাগরিক অবশ্যই করতে পারেন। যে সাক্ষীর সাক্ষের ওপর রেলমন্ত্রীর দুর্নীতি বিষয়ক মামলাটি বড় আকারে নির্ভরশীল, সেই সাক্ষীর কোনো খোঁজখবর নেই এটা কোনো গুরুত্বহীন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারের অপহরণ, গুম, খুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আন্দোলন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের একজন সাক্ষীকে গুম করে গায়েব করে দেওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। উপরন্তু এটাই এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। বর্ডার গার্ড ড্রাইভার আজমকে অন্য তিনজনের মতো ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু তাদের যে এক সঙ্গে ছাড়া হয়নি, এটা অন্য তিন কর্মচারী তাদের প্রাথমিক বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন। এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্ডার গার্ড বলেছে, পরে ড্রাইভারকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ডার গার্ডের এই কথার ওপর আস্থা রাখার মতো বাস্তব অবস্থা বাংলাদেশে নেই। তারা হলো বাংলাদেশ সরকারের অধীন সশস্ত্র সংস্থা। তাদের ভূমিকা পুলিশ ও র‌্যাবের থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেই এখন ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের চরিত্র এবং ভূমিকাও যে কতখানি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সেটাও এ প্রসঙ্গে ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ আছে। গরিব ড্রাইভার আজমের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বৈদ্যুতিন ও সংবাদপত্রমাধ্যমের এই উৎসাহের অভাব ও নীরবতার তাৎপর্য অবহেলার বিষয় নয়।
৪.৬.২০১২
 

No comments

Powered by Blogger.