স্মরণ-কিংবদন্তির লাল মিয়া by কাজী শওকত শাহী

নড়াইল জমিদার বাড়ির রাজমিস্ত্রি মেসের মোল্লার কিশোরপুত্র লাল মিয়া। জমিদার বাড়ির কারুকার্যখচিত দালান, মিনার, নকশা করা চূড়ামনি, সিংহ দরজা, পশুপাখির মূর্তি, স্তম্ভের ওপর সিংহের মূর্তি তাঁকে টানে। এগুলোর ভেতর তাঁর পিতার আঁকা নকশা আর কাঠের কারুকাজও আছে। সেই থেকে আনমনে মাটির ওপর আঁচড় টেনে আঁকাআঁকির শুরু।


তাঁর কচি হাতের আঁকা ছবি দেখে অবাক জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় আর স্কুলের ড্রইং শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য।
ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র কলকাতা আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অরুণ রায়ের চোখে পড়ল লাল মিয়ার শিল্পী প্রতিভা। ১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সেই স্কুলে আসেন বিখ্যাত নেতা শ্যামা প্রাসাদ মুখার্জি। লাল মিয়া তাঁর প্রতিকৃতি এঁকে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। সেই শিশুটিই দিনে দিনে হয়ে উঠবে চিত্রকলার জগতের এক কিংবদন্তি। তাঁর জীবনের মতো শিল্পকর্মও হয়ে উঠবে অনন্য, তা কেন জানত তখন?
১৯২৩ সালের আগস্ট মাসের ১০ তারিখে যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমান জেলা) মাছিমদিয়া গ্রামে, চিত্রা নদীর পাড়ে তাঁর জন্ম। শিশুকালেই মাকে হারান। পড়াশোনার শুরু ১৯২৮ সালে, নড়াইল কলেজিয়েট স্কুলে। শিল্পী হওয়ার প্রবল বাসনায় ১৯৩৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় সেই বালক গ্রামের মায়া ছেড়ে পাড়ি জমালেন কলকাতায়। আশ্রয় পেলেন কাশিপুরে জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে। এখানে তাঁর বেশ ভালো লেগে গেল। জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র অরুণ রায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকা, মেথরপাড়ায় গিয়ে নাচ দেখা, আর শ্মশানঘাটের কীর্তন শুনে কেটে যেত সারা দিন।
এর মধ্যেই মেতে উঠলেন আর্টস কলেজে ভর্তি হওয়ার উন্মাদনায়। অরুণ রায়ের সহযোগিতায় ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। ১৫ মিনিটে নির্ভুলভাবে আঁকলেন ভেনাস ডি মিলের ছবি। ফলাফলের মন্তব্যে অধ্যক্ষ মুকুল দেব লিখলেন, ‘পাস অ্যান্ড ফার্স্ট’। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। এন্ট্রান্স পাস সার্টিফিকেট ছাড়া ভর্তির নিয়ম নেই। জমিদার ধীরেন রায়ের হস্তক্ষেপে তারও সমাধান হলো। থাকার ব্যবস্থা হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে। শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর নতুন নাম রাখলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান অর্থাৎ এস এম সুলতান।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়) চিত্রকলার শিক্ষা নিলেন। এ সময় ‘নৃত্যকলা স্কুলে’ সাধন বোসের কাছে নৃত্যচর্চাও করতেন। সেই সোনালি দিনগুলোতে যেসব বরেণ্য ব্যক্তির সাহচর্য তিনি পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, যামিনী রায়, আবু সাঈদ চৌধুরী, উদয় শংকর, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী, জয়নাল আবেদীন ও কামরুল হাসানের স্মৃতি উজ্জ্বল।
কিন্তু আর্ট কলেজে আটকে থাকলেন না। ঘুরলেন আগ্রা, সিমলা, মুশৌরী ও কাশ্মীর। ১৯৪৬ সালে সিমলায় প্রদর্শিত হলো তাঁর একক চিত্র। সেটাই শিল্পীজীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোর এবং করাচিতেও তাঁর চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় একবার পিতার মৃত্যুর সংবাদে মাছিমদিয়ার পোড়াভিটায় ছুটে আসেন সুলতান।
পাকিস্তানে পরিচয় হলো ফিরোজ খান নুন ও ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ডেকে পাঠালেন। সুলতান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন-এ নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হাউস; মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থানে তাঁর চিত্র প্রদর্শিত হয়। লন্ডনের হ্যামস্ট্রিটে ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে পিকাসো, দালি, ক্লীসহ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ছবিও প্রদর্শিত হয়।
১৯৫৩ সালে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আমন্ত্রণে কিছুদিন থাকলেন সেগুনবাগিচায়, ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে। এ সময় তিনি শাড়ি পরতেন, পায়ে নূপুর পরে নাচতেন, বাঁশিও বাজাতেন, ছবিও আঁকতেন প্রচুর।
সারাজীবন এমন বিশেষত্ব নিয়ে ছবি এঁকেছেন যা দেখে বোঝা যায় এস এম সুলতানের ছবি। ছবি বিক্রি হতো প্রচুর, কিন্তু তার কোনো হিসেব ছিল না। সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল। শহর আর ভাল লাগে না তাঁর। নড়াইলে এসে জমিদারদের ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা শেখানো হতো। কিন্তু জমিদার বাড়ির শেষ অংশটুকু ধ্বংসের কাজ তখন এগিয়ে চলেছে। বাধ্য হয়ে স্কুলটা বন্ধ করে দিতে হলো। পৈত্রিক নিবাসও অন্যের দখলে। চলে এলেন চাচুড়ী পুরুলিয়ায় মামার বাড়িতে।
সৌভাগ্যক্রমে পুরুলিয়া গ্রামে কৈলাশ ঠাকুরের জঙ্গলাচ্ছাদিত প্রাচীন বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। কিছু উৎসাহি লোকের সাহায্যে এই ভুতুড়ে বাড়িটিকে সংস্কার করে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নন্দন কানন, দি স্কুল অব ফাইন আর্টস’। সঙ্গে চলতে থাকে প্রাথমিক শিক্ষার কাজ। পরে এখানে উচ্চ বিদ্যালয়ও করেন।
এগার খানের নমশুদ্রদের সঙ্গে মিশতেন। বাঁকড়ী গ্রামের সান্ধ্যআসরে তিনি ছিলেন গোঁসাই। গোঁসাইকে নিয়ে নাচগান হত। নিজেও নাচতেন, বাঁশি বাজাতেন। ১৯৬৯-এ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নড়াইল কুড়িগ্রাম ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউশন’। ঢাকার সোনারগাঁয়েও তিনি একটি আর্ট স্কুল খুলেছিলেন।
যশোর অধ্যক্ষ মরহুম আব্দুল হাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনে ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ খোলেন। ১৯৭৩ সালে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চারুকুঠি’ চারুকলা প্রতিষ্ঠান।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে এবং ১৯৭৮ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় তাঁর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। অন্যত্রও তাঁর ছবির প্রদর্শনীহয়।
তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’ ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ ও ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পান। বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট হিসেবে বিশেষ সম্মান এবং সর্বোপরি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ উপাধিতে ভূষিত করে, লেখা হয় তাঁর জীবনী।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় খরচে একটি সুন্দর বাড়ি বানিয়ে দেন। পরে সেই বাড়িটিতেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক আনন্দ জগৎ—গাছ-গাছালী, লতাপাতা, ফুলে-ফলে ভরা এক শিশু ভুবন। এই চিরকুমার শিল্পীর নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল বিভিন্ন ধরনের পশুপক্ষী। চির আপন শিশুদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শিল্পকলার স্কুল, ‘শিশুস্বর্গ’। এই বরেণ্য শিল্পী অক্টোবর ১৯৯৪ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১০টায় চিরবিদায় নেন।
লেখক: অধ্যাপক ও সাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.