বিশ্ব পরিবেশ দিবস-পরিবেশ সুশাসনের প্রত্যাশায় by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

বাংলাদেশে পরিবেশ আইনের প্রয়োগ নেই কিংবা পরিবেশ আইন পরিবেশ অধিদপ্তরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ—এমন অভিযোগ দেওয়ার অবকাশ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট টিম নিরপেক্ষতার সঙ্গে আইন প্রয়োগ করে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পরিবেশ-সেবা পৌঁছে দিচ্ছে।


২০১০-এর জুলাই থেকে কার্যত পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযান সমাজের অনেক স্তরে অভূতপূর্ব পরিবেশ-সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করেছে। পরিবেশকে বিপন্ন করে দূষণকারীরা বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়লেও পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়েছে অপরিমেয়। সাধারণ মানুষ অসহায়ভাবে পরিবেশ-সন্ত্রাসের শিকার হলেও পরম নির্ভরতায় কাছে পায়নি কাউকে। ফলে দূষণ ও দখলের অপরাধ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। এসব অপরাধের শীর্ষে আছে: ইটভাটায় দরিদ্র মানুষের জমি দখল, নির্বিচারে কৃষি জমি ধ্বংস, অসহনীয় বায়ুদূষণ, বেপরোয়াভাবে জলাভূমি ভরাট, কারখানার বর্জ্যে নদী ও খাল-বিলের পানিদূষণ, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ইত্যাদি। এসব কারণে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে মানুষের শান্তিময় জীবন, অনাবিল প্রকৃতি ও নির্মল পরিবেশ।
‘এনফোর্সমেন্ট’ নামক নতুন মাত্রার এক দূষণবিরোধী অভিযানের সূচনার ফলে পরিবেশ আইন কী, কেন এর প্রয়োগ, পরিবেশ আইন অমান্যের শাস্তি কী, দূষণ বন্ধের উপায় কী, কীভাবে দূষণের প্রতিকার হবে—এসব বিষয়ে জনগণ বুকভরা আশা ও সাহস নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে হাজির হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ই-মেইলে, টেলিফোনে, চিঠিতে ও সাক্ষাতের মাধ্যমে মানুষের অভিযোগের স্রোত আসছে অধিদপ্তরে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট টিম এক কঠিন যুদ্ধে নেমেছে। অর্থবিত্তের অহংবোধে আচ্ছন্ন হয়ে যারা পরিবেশ অধিদপ্তরে কখনো পদার্পণ করেনি, এনফোর্সমেন্টের আইনি চাপে পড়ে তারা অধিদপ্তরে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাজির হচ্ছে এখন নিয়মিত। ‘পরিবেশ অপরাধী’ হিসেবে তারা জনগণের কাছে চিহ্নিত ও সামাজিকভাবে নিন্দিত হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ-দণ্ড পরিশোধ করছে লাখ লাখ টাকায়। মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও প্রকৃতির প্রতি বৈরিতার শাস্তি এ ক্ষতিপূরণ-দণ্ড। শিল্পায়নের নামে কত নির্মমভাবে পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তার অজস্র ঘটনা সাম্প্রতিক এনফোর্সমেন্ট অভিযানে উদ্ঘাটিত হচ্ছে। বাইরে ঝকঝকে কারখানাগুলো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এমনকি রাতের আঁধারে লোকচক্ষুর অন্তরালে কী ভয়ানক দূষণ ঘটাচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য। এনফোর্সমেন্ট অভিযানে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ ভাগ শিল্প-কারখানা বর্জ্য পরিশোধনাগার বন্ধ রেখে নির্বিবেকে দূষিত পানি খালে, বিলে, নদীতে কিংবা কৃষকের জমিতে ফেলছে।
জনজীবনে পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব, পরিবেশ আইনে শাস্তির মাত্রা, পরিবেশ ক্ষতিপূরণ, দূষণ বন্ধের পদ্ধতি—এসব বিষয়ে মানুষের চিন্তা এবং পরিবেশবাদীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে অনেক গভীরে। এনফোর্সমেন্ট অভিযানে পরিবেশ অপরাধীকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা পরিবেশ সুশাসনের পথ সুগম করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ের এ প্রক্রিয়া পিপিপি (পলিউটারস পে প্রিন্সিপাল) বা ইকো-ট্যাক্স নামে স্বীকৃত। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৭ ধারা মোতাবেক এ ক্ষতিপূরণ ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষতিপূরণ আদায় ন্যায়সংগত। শিল্প উদ্যোক্তারা বর্জ্য পরিশোধন কার্যক্রম পরিচালনার খরচ অন্যায়ভাবে সাশ্রয় করে অনৈতিকভাবে যে মুনাফা অর্জন করছেন, পরিবেশের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সে অর্থই আদায় করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দূষণের বিনিময়ে অর্জিত এ অনৈতিক আয় মালিকদের পকেটে আসছে, যা পরিবেশের জন্য ব্যয় করা অপরিহার্য। এ ব্যয় জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য, বিশুদ্ধ বায়ু নিশ্চিত করার জন্য, সুপেয় পানির অধিকারের জন্য এবং মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনের অস্তিত্বের জন্য। অর্থের প্রতি উদ্যোক্তাদের যেমন আকর্ষণ থাকবে, পরিবেশের প্রতিও তেমন ভালোবাসা থাকবে। কিন্তু শিল্পায়ন ও বিনিয়োগকে দূষণের সমান্তরালে আনা যাবে না। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রমাণ করেছে, অর্থ দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে কিংবা রক্তচক্ষু দেখিয়ে পরিবেশ আইনের প্রয়োগকে বিঘ্নিত করা যায় না। পরিবেশ অধিদপ্তর গত দেড় বছরে দূষণপীড়িত ৩১টি জেলায় এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০০টি পরিবেশ ধ্বংসের ঘটনা উদ্ঘাটন করে ৪৪ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ আদায়, দূষণকারী প্রায় ৪৫০০ টন সামগ্রী জব্দ এবং বন্ধ করেছে শতাধিক দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এ ছাড়া উচ্ছেদ করেছে দুই শতাধিক ক্ষতিকর স্থাপনা এবং উদ্ধার করেছে ৩০৮ একর ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড় ও উপকূলীয় বনভূমি। সীমিত আকারে হলেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে কৃষকের সবুজ ধানখেত, বর্জ্যমুক্ত করা হয়েছে সাধারণ মানুষের জমি এবং অসহনীয় শব্দদূষণ বন্ধ করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের স্বস্তি। দেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের পর্বতপ্রমাণ সংকটের তুলনায় এ সাফল্য নিশ্চয়ই খুব নগণ্য। কিন্তু পরিপূর্ণ দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অন্তত ১০ বছর নির্বিঘ্নে এ অভিযানের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণকারী এবং দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চিন্তায়-চেতনায় এবং মননে অন্তত নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। পরিবেশ অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রে খুব বিত্তশালী এবং ক্ষমতাশালী হলেও এসব বিবেচনায় এনে কাউকে ছাড় দেয়নি। মানুষ এখন বিশ্বাস করছে, পরিবেশ অধিদপ্তর আইন মান্যতার দপ্তর। মানুষের অভিযোগের শুনানি, সমাধান ও সেবা প্রদানের দপ্তর। সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও স্বচ্ছতায় পরিচালিত এনফোর্সমেন্ট অভিযান জাতির কাছে যে সতর্ক বার্তা দিচ্ছে, তা হলো: পরিবেশ ধ্বংস করে শিল্পায়ন, নগরায়ণ কিংবা উন্নয়ন অন্যায়, অনৈতিক ও অমানবিক।
বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের সিংহভাগ ঘটনার শিকার নিরীহ জনগণ। পরিবেশদূষণের ঘটনায় কী বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত এবং জনজীবনে কী বিরূপ প্রভাব ফেলে—আর্থিক মূল্যে তার প্রকৃত হিসাব নিরূপণ সত্যিই কঠিন। পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণের অপরাধে ক্ষতিপূরণ আদায় করলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বা জীবজগতের অতীত জীবনধারা, প্রাকৃতিক সম্পদের অকৃত্রিম অবস্থা কিংবা স্বস্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার আগের ঠিক অবিকল অবস্থায় হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট অভিযানে দণ্ডিতদের কাছে এ বার্তাই দেওয়া হচ্ছে, এ ক্ষতিপূরণ-দণ্ড পরিবেশ অপরাধের প্রাথমিক শাস্তি। পরিবেশ অধিদপ্তর দণ্ড প্রদানের পাশাপাশি দূষণকারীদের মধ্যে নৈতিকতা জাগ্রত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এভাবে মানুষ ক্রমান্বয়ে সাহসী ও সচেতন, দূষণকারীরা সতর্ক ও সংশোধন এবং পরিবেশবাদীরা আশাবাদী ও উজ্জীবিত হচ্ছে। এনফোর্সমেন্ট অভিযান যুগপৎ নিশ্চিত করেছে ভুক্তভোগীদের মুক্তি ও অপরাধীদের শাস্তি। তাই বাংলাদেশে এনফোর্সমেন্ট অভিযানের এ ধারা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রেখে পরিবেশ সুশাসন নিশ্চিত করা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক (মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদপ্তর।
mmunirc@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.