ঢাকার ওপর জাতিসংঘ ও বিসিএসের সমীক্ষা-এক যুগে ৯০ শতাংশ জলাভূমি ভরাট by ইফতেখার মাহমুদ

ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠছে ঢাকা। জলাশয় কমছে আশঙ্কাজনক হারে। সবুজ বনানী আর বৃক্ষের ছায়াতল সংকুচিত হয়ে আসছে। মাটি, পানি আর ঘাস ঢেকে যাচ্ছে কংক্রিটের আস্তরণে। ধুলা আর দূষণে অতিষ্ঠ নগরজীবন।বিশ্বের নয়টি শহর নিয়ে পরিচালিত জাতিসংঘের তিনটি সংস্থার এক চলমান সমীক্ষায় বাংলাদেশের রাজধানীর এই চিত্র উঠে এসেছে।


ঢাকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর ওপর সমীক্ষাটি চালিয়েছে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএসএস)।
আফ্রিকার ছয়টি ও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি শহরের ওপর এ সমীক্ষা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের চারপাশে কৃষিজমি হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলো দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে। তৈরি হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। জলাভূমিগুলোও এই দখল থেকে বাদ যাচ্ছে না। শহরের আশপাশ থেকে কৃষিজমি ও জলাভূমি ক্রমশ ধ্বংস হওয়ায় পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন কমছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু ও ভারতের চেন্নাই শহরের ওপর পরিচালিত ‘নলেজ অ্যাসেসমেন্ট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড পেরি আরবান এগ্রিকালচার ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের চারপাশে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আর দূরবর্তী এলাকা থেকে খাদ্য এনে রাজধানীবাসীর চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এতে রাজধানীমুখী পরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
সমীক্ষায় বলা হয়, নিম্নভূমি ও জলাভূমি ভরাট করে একের পর এক কংক্রিটের ভবন ও পিচঢালা পথ নির্মাণের ফলে শহরে তাপমাত্রাও বাড়ছে। মার্চ, এপ্রিল, মে—এই তিন মাসে ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে, গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। কারণ, মৌসুমি বায়ু আসার আগের এই সময়ে যে বৃষ্টিপাত হয়, তার উৎস হচ্ছে স্থানীয় নদী ও জলাশয় থেকে সৃষ্ট জলীয় বাষ্প। জলাশয় কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতও কমছে। প্রতিবছর এই তিন মাসে দশমিক শূন্য ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ছে। শীত মৌসুমে শূন্য দশমিক শূন্য ৬১ ডিগ্রি এবং বর্ষায় বাড়ছে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সমীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে শহর ৬২৫টি। পুরোনো শহরগুলোকে অবহেলায় রেখে ও কোনো উন্নয়ন না করে আবার নতুন উপশহর নির্মাণের কথা শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, কৃষি, জলা ও বনভূমিকে অক্ষত রেখে নগরায়ণ করতে হবে। সারা দেশের জন্য একটি ভূমি ব্যবহার বিষয়ে ভৌত পরিকল্পনা তৈরি করে তার ভিত্তিতে নগরায়ণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়, জলাভূমি ভরাট হয়ে শহর থেকে বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পানিনিষ্কাশন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাড্ডা, সাঁতারকুল, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণ ও উত্তরখানের বেশির ভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ছিল। গত এক যুগে এই জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর ও গুলশান আবাসিক এলাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন নেই, এমন এলাকায় মোট জমির মাত্র ৪ শতাংশ।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় কিছু সবুজ বনানী, কৃষিজমি ও জলাশয় থাকলেও তা ধ্বংস হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। এক যুগ আগেও সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জমি ছিল সবুজে ঢাকা, ছিল নদী ও জলাশয়। এক যুগে নগরায়ণ ও উন্নয়নের নামে এলাকাগুলো ধূসর এলাকায় পরিণত হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের আওতাভুক্ত এলাকার মধ্যে শুধু গাজীপুর সদরে ৫৪ বর্গকিলোমিটার বনভূমি রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে নগরগুলোর পরিবেশ ও খাদ্যনিরাপত্তার প্রস্তুতি জানতে জাতিসংঘের পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি, ডব্লিউএমও ও আইপিসিসি সমীক্ষাটি পরিচালনা করছে। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের আসন্ন চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের জন্য সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি হচ্ছে।
সমীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরের ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মাত্র ৩৫ বর্গকিলোমিটার, আর জলাভূমির পরিমাণ ৭০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে আবার রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, সংসদ ভবন লেক, ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশান লেকসহ মোট ১০টি পার্ক ও লেক মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে। এক যুগ আগেও ঢাকায় সবুজ এলাকা ছিল প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার, আর জলাভূমি ছিল ১০০ কিলোমিটারের বেশি।
রাজধানীর বাড্ডা আবাসিক এলাকার স্যাটেলাইট আলোকচিত্র বিশ্লেষণ করে ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ২০০৫ সালে বাড্ডায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৮৬ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সালে তা কমে হয় ৩ দশমিক ৯৫ বর্গকিলোমিটার। ২০১২ সালে নেমে আসে ৩ বর্গকিলোমিটারে।
সমীক্ষাটির নেতৃত্বদানকারী বিসিএএসের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় মানুষ বেড়েই চলেছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন নতুন হুমকি হিসেবে এসেছে। এই নগরের খাদ্য, আবাসন ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শহরকে সুস্থ রাখতে দালানকোঠা, উন্মুক্ত এলাকা, পানি, জলাভূমির এলাকা সুনির্দিষ্ট করে সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
ঢাকার আশপাশের জেলার চিত্র: ড্যাপের মোট জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ঢাকা মহানগর এলাকা ছাড়াও সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর সদর ও কালীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, বন্দর ও সদর এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত ধরা হয়েছে। এক যুগ আগেও এই এলাকাগুলোর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ এলাকা ছিল জলাভূমি ও কৃষিজমি।
২০০৮ সালের কৃষিশুমারিতে দেখা গেছে, সাভারে ৬৩ শতাংশ, কেরানীগঞ্জে ৫৭ শতাংশ, কালিগঞ্জে ৯১ ও গাজীপুর সদরে মাত্র ৪১ শতাংশ এলাকায় কৃষিজমি টিকে আছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৭৬, সোনারগাঁয়ে ৬৫, বন্দরে ৭২ ও সদরে ৩৫ শতাংশ কৃষিজমি টিকেছিল। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) যে নতুন উপশহরগুলো স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, তা এই এলাকাগুলোর মধ্যে। গত চার বছরে এসব এলাকায় প্রায় ৪০০ বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান জমি ভরাট শুরু করেছে। ফলে ওই এলাকাগুলোতে কৃষিজমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

No comments

Powered by Blogger.