নিঝুম দ্বীপের কান্না-১-গাছ কাটা কোনো ব্যাপারই না! by নওশাদ জামিল

নদী ঘেঁষেই বিশাল ম্যানগ্রোভ বন। বড় বড় কেওড়াগাছ দুলছে হাওয়ায়। পর্যটকরা উৎসাহী হয়ে ঢুকছেন বনে। কিন্তু কিছুদূর এগোলেই তাঁরা দেখতে পান, বন নেই। গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে শুধু। সেখানে তৈরি হচ্ছে বসতবাড়ি।
নিঝুম দ্বীপে গাছ কেটে চলছে ভূমি দখলের মহোৎসব।


ফলে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দ্বীপ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এতে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে দ্বীপের পরিবেশ। বিপন্ন হাজারো হরিণ। পরিবেশবিদরা বলছেন, গাছ কাটা বন্ধ না হলে গোটা দ্বীপই একসময় বিলীন হয়ে যাবে।
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নোয়াখালীর এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩ বর্গকিলোমিটার। এর তিন-চতুর্থাংশজুড়ে রয়েছে বন বিভাগের ম্যানগ্রোভ বনভূমি। অবাধ নিধনের ফলে এই বনভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে এ নিধনযজ্ঞ। সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ ঘুরে এই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
ম্যানগ্রোভ বন ও হরিণের জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপ হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত। মানচিত্রে দেখতে অনেকটা চোখের মতো মনে হয় হাতিয়াকে। আর এই চোখ থেকে ঝরে পড়া একফোঁটা অশ্রু যেন নিঝুম দ্বীপ। তবে সব সময় পরিবেশ নিঝুম থাকে না এখানে। বনের ভেতরে ঢুকলে প্রায়ই শোনা যায় গাছ কাটার শব্দ। দূর থেকে সে শব্দকে আর্তনাদ বলেই মনে হয়।
জানা যায়, স্থানীয় বন বিভাগে জনবলের অভাব, ভূমিহীনদের পুনর্বাসনব্যবস্থা না থাকা এবং বণ্টনে দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন কারণে এই বনভূমি দখল হচ্ছে বলে স্থানীয় বন অফিস ও সচেতন মহল মনে করে।
নিঝুম দ্বীপ বন রক্ষার দায়িত্ব নোয়াখালী বন বিভাগের। জাহাজমারা রেঞ্জ অফিসের আওতায় নিঝুম দ্বীপের চর ওসমানে একটি বনবিট আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। এ কার্যালয়ে বর্তমানে বন প্রহরী, কর্মচারী ও কর্মকর্তা মিলিয়ে জনবল মাত্র সাতজন। নিঝুম দ্বীপের চর কমলা, চর রশীদ ও চর ওসমানসহ তিনটি এলাকার বিশাল বনাঞ্চল এই সাতজনকেই দেখাশুনা করতে হয়। বন প্রহরী মোজাম্মেল হক সেলিম জানান, বিশাল বনাঞ্চলের তুলনায় জনবল কম হওয়ায় বন রক্ষণাবেক্ষণে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে আরো পাঁচজন লোক হলে দৈনন্দিন কাজে কিছুটা সুবিধা হতো।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, মেঘনা নদীর অববাহিকা হাতিয়ার উত্তরাংশ ভাঙনের কবলে। সেখানকার ভূমিহীনরা এসে ভিড় করছে নিঝুম দ্বীপে। ফলে জনসংখ্যার আধিক্য এবং বসতি স্থাপনের তাগিদে বন উজাড় হচ্ছে। ফলে নিঝুম দ্বীপের বিভিন্ন অংশ এখন পরিণত হয়েছে ধু-ধু বালুচরে। ভূমিহীন জোতদার এবং স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তারাও এই বন ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতি এবং কিছু বন প্রহরীর সহযোগিতায় একশ্রেণীর অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী প্রতিদিন গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। দেড় থেকে দুই ফুট বেড় এবং ১৫-২০ ফুট লম্বা একটি কেওড়া গাছ ২০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অধিকাংশ জেলে এসব গাছের ক্রেতা। জালের খুঁটির কাজে এসব গাছ ব্যবহৃত হচ্ছে। গাছের ডালপালা ছোট ছেলে-মেয়েরা আঁটি বেঁধে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। এ জন্য বন প্রহরীদেরকে ঘুষ দিতে হয় বলে তারা জানায়।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানা যায়, কাজীরবাজার, বুড়িরচর ও নিঝুম দ্বীপের গভীর অরণ্যের খালসংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা নৌকা ও ট্রলারে করে দ্বীপের বাইরে কাঠ নিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে হাতিয়ার স্থানীয় অধিবাসী রফিক উদ্দিন এনায়েত বলেন, নিঝুম দ্বীপ ও হাতিয়া অঞ্চলের বনভূমি উজাড় করে জমি দখলের ঘটনা নতুন নয়। স্থানীয়ভাবে বন কর্মকর্তাদের গাফিলতির জন্যই এখানে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল।
স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, গাছ কেটে বনভূমি দখল করে প্রতি বিঘা জমি বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। নিঝুম দ্বীপ, দমারচর, চর কালাম, চর ওসমান, চর কমলা ও পার্শ্ববর্তী মেঘনা এবং শাখা নদীর চরগুলোয় গাছ কেটে এইভাবে বিক্রি হচ্ছে জায়গা।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে নিঝুম দ্বীপ। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে এখানকার পরিবেশের ওপর নেমে এসেছে নানা বিপর্যয়। ঘূর্ণিঝড় আইলা প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল এই দ্বীপে। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সে আঘাতের মাত্রা ছিল তীব্র। অবাধে গাছ কাটার কারণে হরিণের খাদ্যের আকালও দেখা গেছে।
নিঝুম দ্বীপের রেঞ্জ অফিসার জাবের হোসেন বলেন, 'গাছ কাটার কথা অস্বীকার করব না। এখানে আমাদের লোকবল মাত্র সাতজন। জলদস্যুরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি আমাদের নেই। আমরা অসহায়।'
নিঝুম দ্বীপের প্রধান সম্পদ কেওড়া বন। কিন্তু তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। সম্প্রতি বন বিভাগ কিছু নোনা ঝাউ রোপণ করেছে। সেগুলোও বড় হতে পারছে না। এখানে ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ রয়েছে। সেগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্থানীয় অধিবাসীরা বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোরভাবে দমন করার দাবি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.