মিডিয়া ভাবনা-সংবাদপত্রের কলাম ও টক শো কতটা কার্যকর? by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সংবাদপত্রে কলাম লেখা এখন অনেক লেখক ও বিশেষজ্ঞের প্রিয় কাজ হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংবাদপত্রের কলাম, বিশ্লেষণ বা ভাষ্য পাঠকের এক প্রধান আকর্ষণ। অন্যান্য দেশের সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা সামগ্রিক পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা ঠিক নয়। নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যতিক্রমী।


কাজেই আমি বাংলাদেশ প্রসঙ্গেই আলোচনা করব।
সংবাদপত্রের কলাম বা কলামিস্টদের সম্পর্কে কোনো মতামত জরিপ বা গবেষণা আমার নজরে পড়েনি। যদি সে রকম কোনো গবেষণা হতো তাহলে তার ফলাফল উদ্ধৃত করে নানা আলোচনা করতে পারতাম। দুঃখের বিষয়, আমাদের সংবাদপত্র, টিভি বা বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো গবেষণাধর্মী পর্যালোচনা করার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’ ও ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ পুরোপুরি ব্যর্থ। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ও এই দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব দেয়নি কেন তাও এক প্রশ্ন বটে। সাংবাদিকতা ও টিভি অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নে মতামত জরিপ ও অনুষ্ঠান পর্যালোচনা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারত। অবশ্য যদি তা পেশাদারি দক্ষতায় রচিত হয়।
যা-ই হোক, যা নেই তা নিয়ে আক্ষেপ করে হতাশা বাড়িয়ে লাভ নেই। আজ আমি আলোচনা করছি সংবাদপত্রের কলাম প্রসঙ্গে।
নানা রকমের কলাম সংবাদপত্রে প্রতিদিন ছাপা হয়। কোন ধরনের কলাম পাঠক পছন্দ করেন তা জানার কোনো মানদণ্ড খুঁজে পাইনি। সব পাঠক যে সংবাদপত্রে চিঠি লিখে মতামত প্রকাশ করেন, এমনও নয়। প্রথম আলোতে মাত্র দু তিনজন কলামিস্টের কলাম সম্পর্কে পাঠকের চিঠি বা প্রতিক্রিয়া নিয়মিত ছাপা হতে দেখি। তাতে এটা মনে করা ঠিক হবে না যে অন্য কলাম পাঠক পড়েন না।
শুধু একধরনের কলাম সম্পর্কে আমার আজকের লেখা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। যে কলামে মন্ত্রণালয় বা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম মূল্যায়ন করে পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ কলাম লেখকের টার্গেটই হচ্ছেন মন্ত্রী বা সচিব বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান। মন্ত্রী বা সচিব বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি ওই লেখা না পড়েন তাহলে ওই লেখাটির কোনো সার্থকতা নেই। এক হাজার পাঠক প্রশংসা করলে বা ১০০ পাঠক সংবাদপত্রে চিঠি লিখলেও লেখকের ওই লেখার কোনো সার্থকতা নেই। তাহলে পরামর্শ বা সুপারিশমূলক লেখার সার্থকতা কোথায়?
সার্থক হতো, যদি মন্ত্রী বা সচিব বা নীতিনির্ধারকদের কেউ সেই লেখার পরমার্শগুলো বিবেচনা করতেন। অবশ্য যাঁরা শুধু পাঠককে আনন্দ দেওয়ার জন্য লেখেন তাঁদের কথা আলাদা। তাঁরা পাঠকের প্রশংসা বা স্তুতি শুনেই তৃপ্ত।
শুধু সুপারিশমূলক লেখা নয়, সমালোচনা বা পর্যালোচনামূলক লেখারও একটা তাৎপর্য আছে। যাঁর বা যাঁদের উদ্দেশ্যে লেখাটি রচিত হচ্ছে তাঁরা যদি ওই সমালোচনা বা পর্যালোচনা পড়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও আত্মসমালোচনায় বসেন, তাহলেও লেখাটির উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হয়। যদি টার্গেট দল বা নেতা-নেত্রী কেউ সেই সমালোচনায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করেন, তাহলে লেখাটির কোনো সার্থকতা থাকে না। অবশ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্যাম্পের সমর্থকেরা এ ধরনের সমালোচনামূলক লেখায় আমোদিত ও ক্ষুব্ধ হন। একটা লেখা দুই ক্যাম্পের পাঠককে খুশি করতে পারে না।
সংবাদপত্রের কলাম পড়ে সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের নীতি কতটা পরিবর্তন করেছেন বা নতুন নীতি প্রণয়ন করেছেন তার কোনো হিসাব কেউ দিতে পারবেন না। বছরে এ রকম ঘটনা একটি ঘটে কি না সন্দেহ। তবে সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মিলে একযোগে সরকারের কোনো একটি নীতি বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলে তখন সরকার পিছপা হতে বাধ্য হয়। তবে সব সংবাদপত্র ও টিভির একই সুরে একটি সরকারি নীতির বিরোধিতা করা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। বাংলাদেশের মিডিয়ায় এ রকম মতৈক্য হয় না বললেই চলে। কিছুদিন আগে বিদ্যুৎ বাঁচাতে এক ঘণ্টা সময় পিছিয়ে ও এগিয়ে দেওয়ার মতো সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা সবাই একযোগে করেছিল। এটা খুবই ব্যতিক্রমী।
এখানে দেখতে হবে, এমন একটি সিদ্ধান্ত (এক ঘণ্টা) সরকার মিডিয়ার সমালোচনায় প্রত্যাহার করেছে, যে সিদ্ধান্তে সরকারি দল, সরকারি দলের সাংসদ, এমনকি সরকারও তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ক্ষতি বা লাভ যা-ই হবে তা সমগ্র দেশের। কিন্তু সরকারি দল বা সাংসদেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এমন কোনো সরকারি নীতি কি মিডিয়ার সমালোচনায় বাতিল করেছেন? বা পুনর্বিবেচনা করেছেন? করেননি। দুটি উদাহরণ: ১. সাংসদদের স্বার্থে (আর্থিক ও প্রভাব) উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করছে না সরকার। প্রায় সব মিডিয়া এর সমালোচনা করেছে। ২. ছাত্রলীগের টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও সন্ত্রাসের অভিযোগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি। ছাত্রলীগকে প্রশ্রয়ও সরকার কম দিচ্ছে না। সব মিডিয়া কিন্তু ছাত্রলীগের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
কাজেই সংবাদপত্রের কলাম সরকারের বা দলের নীতিনির্ধারণে তেমন ভূমিকা পালন করছে বলে আমার মনে হয় না। বছরে একটি-দুটি লেখা (কলাম) হয়তো সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে। যে সুপারিশে দল বা দলীয় সাংসদেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
টেলিভিশনের টক শোর অবস্থা আরও করুণ। আমার ধারণা, টেলিভিশনের সিরিয়াস টক শোর ৯০ শতাংশই বিনোদন। তারকাপ্রধান টক শো তো বিনোদনের লক্ষ্যেই প্রচারিত হয়। কাজেই সেগুলো সফল। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজবিষয়ক সিরিয়াস টক শো সরকারের নীতিনির্ধারকদের কতটা প্রভাবিত করে বলা মুশকিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তেমন প্রভাবিত করে না। রাত ১১টা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত টিভির টক শো থেকে বিশেষজ্ঞ বা সিভিল সোসাইটির নেতাদের মতামত বা পরামর্শ শোনার জন্য আমাদের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী বা সচিবেরা জেগে বসে আছেন, তা অনেকটা কষ্টকল্পনা মাত্র। জেগে থাকলেও রাত ১২টার সময় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা কতটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। মনোবিজ্ঞানীরা এসব বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে মন্ত্রী, নীতিনির্ধারক বা সাংসদদের অনেকেই নিয়মিত টক শো শোনেন বলে শুনেছি। আমার ধারণা, তা প্রধানত বিনোদনের জন্য। টক শো থেকে মন্ত্রী, সচিব বা সাংসদেরা কোনো পরামর্শ গ্রহণ করেছেন এমন কথা শোনা যায়নি। কোনো প্রমাণও দেখিনি।
মিডিয়ায় মন্ত্রণালয় বা সরকারি বিভাগসংক্রান্ত কোনো সমালোচনা বা পর্যালোচনা হলে তার সারসংক্ষেপ মন্ত্রী বা সচিব বা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধানের কাছে নিয়মিত দেওয়ার কোনো পদ্ধতি আছে বলে আমার জানা নেই। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে কিছুটা থাকলেও টিভির টক শোর ক্ষেত্রে যে নেই, তা অনুমান করি। কারণ কাজটা সহজ নয়।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি। কোনো একটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আমার একটি কলাম (অনেক পরামর্শসহ) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি না-সূচক জবাব দিয়ে বলেন, তাঁর পিএসের কাছে ফটোকপি পাঠাতে। আমার পাঠাতে ইচ্ছে হয়নি। কারণ এই লেখা মন্ত্রীর গোচরে আনার জন্য কয়েকজন বেতনভুক কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। মন্ত্রীকে ফটোকপি পাঠানো আমার দায়িত্ব নয়। তা ছাড়া বিষয়টার সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থও জড়িত নেই।
আমার মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, সংবাদপত্রের কলাম লেখা পাঠক-বিনোদনের চেয়ে বেশি কিছু নয়। অনেক লেখক পাঠকের প্রশংসা উপভোগ করেন, তাঁদের একটা তৃপ্তি থাকতে পারে। কিন্তু যাঁরা সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য লেখেন, তাঁদের কলাম লেখার কথা দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। অথবা তারাও বিনোদনের দলে ভিড়ে যেতে পারেন। তাহলে আর মনোকষ্ট হবে না।
সংবাদপত্রের কলাম ও টিভির টক শো সম্পর্কে এই বয়ান আমার কল্পনাপ্রসূত। কাজেই কোনো পাঠক এই মতামতের কোনো মূল্য না দিলে তাঁকে আমার বলার কিছু নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ‘কলাম’ ও ‘টক শো’ সম্পর্কে ব্যাপক পর্যালোচনা ও পাঠক-দর্শক মতামত জরিপ করে একটা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করত, তাহলে আমরা ‘কলাম’ ও ‘টক শো’র কার্যকারিতা সম্পর্কে সত্যিকার ফিডব্যাক পেতাম। তা যতক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না ততক্ষণ ব্যক্তিগত মতামত নিয়েই পাঠককে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ব্যক্তিগত মতামত সব সময় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেও আমি আবার বলতে চাই, সংবাদপত্রের কলাম ও টিভির রাজনৈতিক টক শো বিনোদনের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.