শ্রদ্ধাঞ্জলি-সন্তোষদা অমর রহে by কামাল লোহানী

সন্তোষ গুপ্ত আমার শ্রদ্ধেয়জন। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। রাজনৈতিক সাংস্কৃতির ও সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁর পরিশ্রমী মানসিকতা কিংবা অন্যায়, অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ, কলম নব প্রজন্মকে প্রচণ্ড সাহসী ও কর্তব্যনিষ্ঠ করেছে। তাঁর সাংবাদিক দক্ষতা কর্মরত প্রতিষ্ঠানকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি উদ্বুদ্ধ করেছে নবীনদের।


তাঁকে অনুসরণ করে বহু কর্মঠ এবং আপসহীন তারুণ্য জীবন প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা পেয়েছেন। আদর্শবাদী এই মানুষটি জীবনকে যেমন সংগ্রামে নিবেদিত করেছিলেন, তেমনি তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক চৈতন্যে নবপ্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন।
সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত কেবল সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ চিন্তায় ছিল মেহনতি মানুষের কল্যাণময় সমৃদ্ধ জগত্ গড়ে তোলার প্রত্যাশা। আর সে কারণেই তিনি মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় নিরন্তর বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি জানতেন, যুথবদ্ধ মানুষেরই শক্তি কেবল পারে অসত্, গণবিরোধী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পাল্টে ফেলতে। বিশ্বময় যে আগ্রাসী যুদ্ধবাদ, সম্রাজ্যবাদ, ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বশান্তির সুউচ্চ পতাকাকে সমুন্নত রাখতে উত্সর্গ করেছিলেন নিজেকে। কিন্তু বিশ্বাসের আদর্শ অর্থাত্ আমাদের ঐকান্তিক প্রবল মন ও সংগঠিত রাজনীতির লক্ষ্য যেন ভ্রষ্ট হলাম এবং ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের বিশ্বাসের আদর্শে এক ভয়াবহ কুিসত বিভাজনে আক্রান্ত হলো। আমাদের সংঘবদ্ধতা একদিন ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল। আমরা আপন ঘরে কালিমা লেপন করলাম। আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রবল শক্তিকে ধ্বংস করে কেমন যেন বিরোধিতায় আত্মতৃপ্তি লাভ করলাম। ভেবে পেলাম না, যে গণশক্তির গর্বিত উত্তরাধিকার আমাদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বিপ্লবের প্রাবল্যে বিশ্বজনগোষ্ঠীকে সুখী, সমৃদ্ধশালী শান্তির পৃথিবী গড়তে, সেখানে কেন এমন ধস নামল। ...সন্তোষ গুপ্ত এর মধ্যেও অটল ছিলেন তাঁর লেখনীতে। তবুও বিশ্বাস করতেন, এ পৃথিবীটা সবার বাস উপযোগী করতে হবে। সেই প্রত্যয়ে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন এই মানুষটি, সর্বক্ষণ। আমৃত্যু সন্তোষদা তাই মেহনতি মানুষের বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সমৃদ্ধ। আর সে কারণেই সন্তোষদা আপসহীন ব্যক্তিত্বের অভিধায় সিক্ত হয়েছিলেন এবং আজও তাঁর কাজ, লেখার মাধ্যমে এক মহান শিক্ষকের ভূমিকায় রয়ে গেছেন।
ব্যক্তিগত একটি কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তা হলো সাংবাদিক ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো একসময় আমরা দুজন ছিলাম প্রতিপক্ষ। কিন্তু ফলাফল আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার জগত্ দূরে সরিয়ে আনতে পারেনি। পারেনি রাজনীতিভিত্তিক ব্যক্তি সম্পর্ককে খর্ব করতে। সন্তোষদা আমাদের সবারই শ্রদ্ধার পাত্র এবং অভিভাবকই থেকে গেছেন। এই যে অনুকরণীয় গুণাবলি এটাই তাঁকে সর্বজনগ্রাহ্য করে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনে সন্তোষদা ছিলেন অপরিমিত শক্তির আধার। নিঃশঙ্কচিত্তে আন্দোলনের অর্থাত্ সাংবাদিকতার উত্কর্ষ সাধনে ছিল তাঁর সব প্রয়াস। তাঁর লেখনীর ক্ষুরধার প্রভাব পাঠক মনকে আকৃষ্ট করত অপরিমেয় শক্তির সম্পদ হিসেবে।
হাতের মুঠোয় জলন্ত সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে মানুষটি নিরন্তর ফুকতেন, তাঁর কী যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল তা অবিশ্বাস্য। তিনি ছিলেন নমস্যব্যক্তি। স্বল্পভাষী এবং নিরহংকার। দেশপ্রেম তো ছিলই, না হলে আদর্শিক বিভাজনের পরও তিনি গণমানুষের রাজনীতিতে বিশ্বাসী থাকতেন না।
মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাননি কোনো দিনও। তাই তো এমন প্রবল প্রাণের মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই মানুষকেই ভালোবেসে গেছেন। মানুষও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করেই চলেছেন। কারণ যে মানুষটি একটি মাত্র আদর্শ-সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, অকপটে সত্য সাধন করার শক্তি ধারণ করতেন, তাঁকে তো জীবনে অকথ্য নির্যাতন, জেল-জুলুম সইতে হয়েছে। তবুও অটল, অবিচল ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে।
তাঁর প্রতি আমাদেরও গভীর, অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধাবোধ থাকবে অনাগত দিনগুলোতে, যতদিন না মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র কায়েম হয়। ...সন্তোষদা চির অমর রহে।

No comments

Powered by Blogger.