নদী দখল-নদীতে অবৈধ স্থাপনা থাকবে না? by মাহবুবা নাসরীন

সকালে ঘুম ভাঙার পর পত্রিকা হাতে নিলেই মনটা ভালো হয়ে যায় এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। যার ব্যতিক্রম ছিল ৬ আগস্টের ছুটির দিনটা। প্রথম আলোয় লাল কালিতে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে ‘নদীতে অবৈধ স্থাপনা থাকবে না’। হাইকোর্টের এই আদেশ সত্যিই যুগান্তকারী।


পরিবেশ আন্দোলন ও গবেষণার সঙ্গে গত ২২ বছরের সম্পৃক্ততার ইতিহাসে অন্যান্য দুঃখজনক খবরের মধ্যেও এই অর্জনকে বড় করে দেখছি এ জন্যই যে, অতীতে নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে যতই সোচ্চার হয়েছি আমরা বা প্রচারমাধ্যম, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নীতি-নির্ধারকদের চোখের সামনে দিয়ে নদী চলে গেছে অবৈধ স্থাপনাকারীদের ইজারার অধিকারে। মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে গেছে তোষামোদকারীদের স্বার্থ। অতীতে বিভিন্ন সময় পরিবেশবাদী সংগঠন, বিশেষত বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) দাবির মুখে (২০০০ সাল থেকে) বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও দেবধোলাই নদী থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান শুরু করে অতীতের সরকারগুলো অজ্ঞাত কারণে আবার তা থামিয়ে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। যার কর্মকাণ্ডের কোনো অগ্রগতি দেখা বা জানা যায়নি। নদীর তীরে স্থাপনা, বর্জ্যের সংগ্রহ ও স্বাস্থ্যসম্মত নিঃসরণ-পরিশোধন, সুষ্ঠু পয়ঃপ্রণালিব্যবস্থা ও এর পরিশোধনের ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৮ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর পরিবেশ-দূষণে অবৈধ স্থাপনা ও শিল্পবর্জ্যের প্রভাবের একটি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার অধীন নদী-দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হাজারীবাগ, শ্যামপুর, পোস্তগোলার ১৪৫ জন নারী-পুরুষসহ বাংলাদেশের সব মানুষের স্বপ্ন হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়ের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, উন্নত দেশের অনুকরণে শিল্পায়নের মাধ্যমে আমরা তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়েছি অপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু যখন আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা পানি প্রকল্পগুলো নিয়ে ক্রমাগত বাণিজ্যিক পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, তখন শিল্পোন্নত দেশগুলো নদীকে ঘিরে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেছে। নদী-দূষণ রোধে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের পানি আইন (Water Act) ১৯৭৭ সালে সংশোধনের মাধ্যমে ভূ-উপরিভাগের পানিকে (surface water) বিশুদ্ধ করেছে। অন্য উন্নত দেশগুলোও ‘নদী-দর্শনে প্রতিবেশগত তত্ত্ব’ (ecological approach towards river philosophy) ব্যবহার করছে। নদীতে যেকোনো কাঠামোগত নির্মাণ বন্ধ করতে হবে—এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিনিময়েও নদীকে ব্যবহার করা যাবে না। অতীত থেকে উদাহরণ নিয়ে বলা যায়, কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করে প্রথমে মাত্র ৬০ মেগাওয়াট এবং পরে ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শেকড়হীন করার মূল্য আমরা আজও দিয়ে যাচ্ছি।
ফারাক্কা বাঁধ তৈরির ফলে পদ্মা, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতীসহ অসংখ্য নদী মরে গেছে বা হারিয়ে যাওয়ার পথে। পানি ছাড়াও মৎস্য, কৃষি ও সার্বিক প্রতিবেশব্যবস্থা এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবৈধ (কখনো কখনো বৈধ) স্থাপনা ও অপরিকল্পিত নীতিমালার কারণে। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে ক্রমবর্ধমান মানুষের জীবন-জীবিকা ও জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে দেশের সব নদ-নদী রক্ষায় বর্তমান সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। ঢাকাসহ সারা দেশের নদী ও জলাশয় বাঁচাতে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), জলাশয় আইন ২০০০ বাস্তবায়নসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীর তীরে শিল্পগুলো যাতে পানি-দূষণ না করতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। টেকসই নগর ও গ্রাম পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করতে হলে প্রয়োজন পরিবেশসম্মত টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা।
শেষ কথা, ২ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, চিংড়ি চাষ ও জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য জোনিং (zoning) ব্যবস্থা করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেগুলো কোথায় হবে? সেই জোনে কি মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর বসবাস থাকবে না? সেই জোনগুলোর পরিবেশ-দূষণ রোধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? যারা এত দিন এই শিল্পগুলোর ওপর ভিত্তি করে জীবিকার্জন করত, তাদের জন্য বিকল্প জীবিকাব্যবস্থা কী হবে? জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলসংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনায় (২০০৯) এই বিষয়গুলো অন্তভূক্ত করাসহ দেশের সব নদ-নদী বাঁচাতে জনগণের কাছে ‘পরিবেশবান্ধব’ হিসেবে ইতিমধ্যে মূল্যায়িত বর্তমান সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে জনগণ তা দেখার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।
মাহবুবা নাসরীন: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.