অভিন্ন নদীর প্রবাহ এবং কৃষি ও পরিবেশ by ড. জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশ একটি নদীবহুল দেশ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ প্রায় ৩৫০টি বড় ও ছোট নদী এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এদের অববাহিকায় আছে অসংখ্য বিল, হাওর ও বাঁওড়। দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে নিম্ন সমতল ও প্লাবণ ভূমি। এর তিন পাশের সীমান্ত ঘিরে অবস্থান করছে ভারত, আর একপাশে আছে মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর।


দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত ৫৭টি নদীর রয়েছে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব। এদের মধ্যে ৫৪টির জলধারা ভারত থেকে এবং তিনটির মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত থেকে প্রবাহিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো- বরাক, তিস্তা ও গঙ্গা। গঙ্গা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, তিস্তা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও বরাক উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর মিলিত হয়েছে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে। এদের পানির তোড়ে বাংলাদেশ কখনো বন্যায় ভাসে, কখনো আবার পানিশূন্যতার কারণে দেশটি খরায় পোড়ে। তাতে কৃষির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিঘ্নিত হয় পরিবেশ। বিপন্ন হয় জীববৈচিত্র্য।
বহুমাত্রিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রবহমান বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হচ্ছে গঙ্গা। হিমালয়ের গাঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে দুই হাজার ৫৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিকটস্থ শিবগঞ্জ দিয়ে নদীটি প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এর পর গোয়ালন্দ ঘাটে এসে মিশেছে যমুনা বা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। অতঃপর তা চাঁদপুরে এসে মেঘনার সঙ্গে মিশে পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল ও চীন নদীটির অংশীদার। শুকনো মৌসুমে গঙ্গার অববাহিকায় নাব্যতা রক্ষা ও কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য নদীটির ভারতীয় অংশে নির্মাণ করা হয় ৩৪টি বাঁধ। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে ভাগীরথী নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারাজ। এর মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হয় হুগলি নদী বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য। ফলে পানি সংকট সৃষ্টি হয় গঙ্গার নিম্নাঞ্চলে বাংলাদেশের পদ্মায়। ১৯৬০ সালে সাত হাজার ৩৬৩ ফুট দীর্ঘ এ বাঁধের নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সালে তা শেষ হয়। এতে বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা ও তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ, এ নদী থেকে ভারত ৪০-৪৫ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তদুপরি অন্যান্য গতিপথেও সরিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কিউসেক পানি। ফলে পদ্মার গতিপথে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে গড়ে ১০-১২ হাজার কিউসেকে নেমে এসেছে। সময় বিশেষে তা নেমে আসে পাঁচ হাজার কিউসেকেরও নিচে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের অধীনস্থ এক লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তদুপরি নদীর অববাহিকায় প্রতিনিয়তই সাগরের লোনা পানি প্রবেশ করছে এবং তাতে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া গঙ্গার উজানে ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রতিবছর প্রায় দুই মিলিয়ন টন পলিমাটি এসে পড়ছে বাংলাদেশে। তাতে চর জাগছে পদ্মায়। নৌ-চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। পানির গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের।
বাঁধটি নির্মাণের শেষ পর্যায়ে ১৯ মার্চ ১৯৭২ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি মোতাবেক যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ঘোষণা করা হয় যে ফারাক্কা কার্যক্রম শুরুর আগে পানি বণ্টনের বিষয়টি মীমাংসা করা হবে। এর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তা আর কার্যকর হয়নি। তবে এর পরবর্তীকালে বিভিন্ন সমঝোতার মাধ্যমে পানি বণ্টনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৩০ বছর মেয়াদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার মধ্যে। ওই চুক্তি মোতাবেক ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত পানির অভাবের সময় বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। তবে এ বিষয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলাফল যা হলো বাংলাদেশ কখনো তা পায়নি। অনেক সময় পানির প্রবাহ এতই নিচে নেমে আসে যে তা স্বাভাবিক নাব্যতা হারায়। তাতে মার খেয়েছে ৬৮৫ কিলোমিটার নৌপথ। বিঘ্নিত হয়েছে পানিসেচ, ক্ষতি হয়েছে ফসলের। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।
একাধিক শরিকানার পরিচয় বহনকারী অপর একটি নদী হচ্ছে তিস্তা। এ নদীর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে উত্তর সিকিমের সো লামো লেইক। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে খরস্রোতা এই নদীটি প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এর পর ১২৪ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পতিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। বাংলাদেশের উজানে এ নদীর গতিপথে ভারত নির্মাণ করেছে তিনটি বাঁধ। এর একটি হচ্ছে শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গজলডোবায় তিস্তা ব্যারাজ। অপর দুটি হচ্ছে ফুলবাড়ীতে মহানন্দা ব্যারাজ এবং চোপড়ায় ডাহুক ব্যারাজ। বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে একটি লালমনিরহাটের ডালিয়া ব্যারাজ। ১৯৭৬ সালে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে সেচ প্রদান ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদানের জন্য। এখনো চলমান আছে এর নির্মাণকাজ। প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে পশ্চিমবঙ্গের ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমি পানিসেচের আওতায় আসবে। বর্তমানে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে এ নদী থেকে পানিসেচ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে তিস্তার বেশির ভাগ পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের অংশে সময়বিশেষে ৪০০ কিউসেক পানির প্রবাহও বিদ্যমান থাকে না। বর্তমানে বাংলাদেশের তিস্তার অবস্থা হয়ে গেছে অনেকটা মরা খালের মতো।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- ভারত বরাবরই বলে আসছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ওই দেশটি করবে না। কিন্তু গত নভেম্বরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করার আগে ভারত তা নিশ্চিত করেনি বাংলাদেশকে। এ নাগাদ উলি্লখিত বিষয়ে কোনো যৌথ সমীক্ষাও হয়নি। এ বাঁধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত সততই একতরফাভাবে নিয়েছে ভারত। অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিও সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি ভারতের পিছুটানের কারণে। এ ক্ষেত্রে তারা সময়ক্ষেপণ করছে সমীক্ষার জন্য। এখনো আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কথা বলছে। ওদিকে তিস্তা অববাহিকার জনপদ প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে বিরান হয়ে যাচ্ছে। কৃষি মার খাচ্ছে। পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে পদ্মা, বিশাল এক বালুচরে পরিণত হচ্ছে গঙ্গা-পদ্মার অববাহিকাও। এগুলোর পেছনেও আশ্বাস ছিল, বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। অথচ অবলীলাক্রমে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে চলছে ভারত, বাংলাদেশের ক্ষতির কথা তেমন ভাবছে না।
ভারত একটি পানি ঘাটতির দেশ। জনপ্রতি পানির প্রাপ্যতা সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় কম। সুতরাং পানির বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারত কেবলই ছাড় দিয়ে যাবে এবং নিজেদের ঘাটতি আরো বাড়িয়ে তুলবে, তেমনটি ভাবা ঠিক হবে না। বরং বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। বর্তমানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সেই সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এখন ভারতেরও তিনটি রাজ্য এসে যোগ দিয়েছে একই দাবি, একই প্রত্যাশা নিয়ে। বাতিল করতে হবে টিপাইমুখ বাঁধ। সেই সঙ্গে আমাদের অনুকূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার নীতিমালা। উজানের দেশ ইচ্ছা করলেই বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশের পানি প্রত্যাহার করে তাকে শুকিয়ে মারতে পারে না। অথবা হঠাৎই পানি ছেড়ে তাকে ভাসিয়েও দিতে পারে না। তা ছাড়া কোনো পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর নয় এমন নীতির ভিত্তিতে সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে ভারত ও বাংলাদেশ ইতিপূর্বে চুক্তিও সই করে রেখেছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক দিক থেকে এখন আমাদের আরো তৎপর হওয়া ও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার। একই সঙ্গে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়গুলো উপস্থাপনের জন্য। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের ন্যায়সংগত অধিকারকে দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রেরই নেই। ভারতেরও না।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ
e-mail : alamj52@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.