চরাচর-আমড়া কাঠের ঢেঁকি by জাহাঙ্গীর হোসেন

'আমড়া কাঠের ঢেঁকি।' ঢেঁকির ধারা নেই, বাগধারাটা আছে। নিরেট অকর্মা বোঝাতে এই অপবাদ দেওয়া হয়। মাছে-ভাতে বাঙালি আমরা এবং বারো মাসে তেরো পার্বণ (অনুষ্ঠান) করার মতো উৎসবপ্রিয় জাতি। এখন মেশিনের যুগ। মেশিনে ধান থেকে চাল হচ্ছে, চাল থেকে পিঠা সরঞ্জাম- চালের গুঁড়া হচ্ছে।


আর এ দিয়েই তৈরি হচ্ছে ভাত, পিঠা, পায়েশ ইত্যাদি। মেশিন তো এলো সবে সত্তর দশক থেকে। তাহলে হাজার বছর ধরে আমরা কিভাবে চাল, চালের গুঁড়া, চিড়া ইত্যাদি পেতাম? এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি করেছে ঢেঁকি। এই ঢেঁকি কিন্তু কঠিন কোনো যন্ত্র নয়। ছয় থেকে সাত হাত লম্বা একটি মাঝারি আকারের গাছের কাণ্ড দিয়ে তা বানানো হয়। ওই কাণ্ডটির নামই ঢেঁকি। মোটা অংশটি রাখা হয় সামনের দিকে। ২/৩ অংশ সামনের দিকে রেখে কাণ্ডটির মাঝ বরাবর মাটির সঙ্গে সমান্তরাল করে একটি ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্র দিয়ে প্রায় দুই হাতের মতো লম্বা একটি শক্ত কাঠ গোলাকার করে কেটে প্রবেশ করানো হয়। কাঠটির দুই পাশে সমান অংশ মূল কাণ্ডটি থেকে দুই পাশে রাখা হয়। এই কাঠটিকে বলা হয় নাচুনি। এবার ইংরেজি ওয়াইয়ের মতো দুটি কাঠের অংশ মাটিতে পুঁততে হয়। একে বলা হয় কিলা। নাচুনির দুই মাথা থাকে দুই কিলার ওপর। কিলার উচ্চতার সমান করে মোটা কাঠ কেটে ওই ছিদ্র থেকে মাটি পর্যন্ত একটা মোটা কাঠ কাটা হয়। একে বলা হয় মুশল। এটি ইচ্ছামতো ঢেঁকির সামনের ছিদ্র থেকে খোলা যায়। মুশল সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটা হচ্ছে কেবল কাঠের একটা গোলাকার দণ্ড; যার নিচের অংশটা ইংরেজি ইউর মতো করে সুন্দর করে ছাঁটা থাকে। আরেকটা হচ্ছে, ওই ইউর মাথায় একটা রিংয়ের মতো করে লোহার বেড়ি দেওয়া থাকে। এই বেড়িকে বলে গুলা। ধান বা চালের গুঁড়া করার সময় গুলা লাগানো হয়। আর চিড়া বা মশলা ভাঙানোর সময় গুলা ছাড়া মুশল লাগানো হয়। এবার ঢেঁকির একেবারে পেছনের অংশে ঢেঁকি বরাবর কিছুটা মাটি গর্ত করা হয়। এবার ঢেঁকির পেছনের অংশে এক বা একাধিক মানুষের পায়ের ভর দিয়ে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। যেহেতু তিন ভাগের দুই ভাগই কিলার সামনের দিকে তাই ধুপ করে ঢেকির মাথাটা নিচের দিকে নামে এবং মুশলটা মাটিতে আঘাত করে। মুশলটা যেখানে আঘাত করে সেখানে সাধারণত শক্ত মাটি বা সিমেন্ট দিয়ে একটি গর্ত করা হয়। আর এই গর্তেই ধান, চাল দেওয়া হয়। পাদানির দুই পাশে দুটি খুঁটি বসিয়ে বুক বরাবর দুটি খুঁটিকে একটি দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এই দড়ি ধরে গ্রামের মহিলারা দুই-তিনজন মিলে পায়ের তালে তালে ঢেঁকিতে পাড় দেয়। ঢেঁকি সাধারণত শক্ত কাঠ দিয়ে বানাতে হয়। জাম, নেওড়া বা বেল গাছের কাঠ হচ্ছে ঢেঁকির আদর্শ কাঠ। এ ছাড়া আম বা কাঁঠাল গাছের ঢেঁকিরও প্রচলন আছে। ঢেঁকি নিয়ে বেশ জনপ্রিয় হাজারও গীত রয়েছে। এই গীতগুলো আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন। যেমন, ধান ভানোরে ঢেঁকিতে ভর দিয়া...। স্বপ্না চক্রবর্তীর বিখ্যাত একটি গান হলো 'ঢেঁকিতে উঠিয়া বলে আমার নাইরে মান/আমার পিছে মেরে লাথি সবাই ভানে ধান/আমি বাঁচাই জীবের প্রাণ।' সময়ের আধুনিকতায় এই ঢেঁকি আজ অবসর নিয়েছে। পাছায় লাথি খেয়েও যে ঢেঁকি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে এই ঢেঁকির অবদান মনে রেখে যেন তার সম্মান আমরা জানাই।
জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.