দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে মূল্যবান নথিপত্র চুরি! by আপেল মাহমুদ

স্পেশাল অডিট চলাকালে মূল্যবান নথিপত্র চুরি হয়ে গেছে। মূলত বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই চুরির ঘটনা ঘটেছে। তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেল অফিসের ডিলিংস অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. আনোয়ার হোসেনের কক্ষে রক্ষিত স্টিলের আলমারির তালা ভেঙে চোররা নিয়ে গেছে রেকর্ডপত্র, ক্যাশ বই, ব্যাংক হিসাবের চেক ইস্যু রেজিস্টারসহ আরো কিছু মূল্যবান কাগজপত্র।


এ ব্যাপারে তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেল অফিসার শাকিল আহমেদের নির্দেশে শ্যামপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং চোর গ্রেপ্তার হয়নি বলে জানায় শ্যামপুর থানা। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সার্কেলে অতীতে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম থামাচাপা দিতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজ করেছে।
সার্কেল অফিস সূত্রে জানা যায়, গত মাসের ২০ তারিখ থেকে স্থানীয় ও রাজস্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাঁদের অফিসে স্পেশাল অডিট পরিচালনা করছেন। একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি অডিট টিম কাজ করছে। তারা মূলত স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের টাকার ব্যয়-সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখছে। কিভাবে এ করের টাকায় সার্কেলের উন্নয়নকাজ করা হয়েছে এবং এতে কোনো দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে কি না এসব খুঁটিয়ে দেখছে তারা। এর মধ্যেই মূল্যবান নথিপত্র রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যায়। অফিসের গেইট ও দরজার তালা এবং জানালার গ্রিল অক্ষত থাকার পরও কিভাবে এ ঘটনা ঘটল সে সম্পর্কে অফিসের কেউই কোনো কিছু বলতে পারছেন না। অথচ অফিসে একজন সার্বক্ষণিক নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে।
সাধারণ ডায়েরি সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ মার্চ সন্ধ্যা ৮টা থেকে ৩ জুন দুপুর ১২টার মধ্যে এ চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুই দিন ছুটি থাকায় পুরো অফিস ফাঁকা ছিল। এ সময়ের 'সদব্যবহার' করে সংঘবদ্ধ চক্রটি। তারা আলমারিতে রক্ষিত অনেক কাগজপত্র থাকার পরও শুধু কয়েক বছরের নির্দিষ্ট নথিপত্র হাতিয়ে নেয়। চুরি যাওয়া নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে ২০০৩ সালের আগের একটি ক্যাশ বই, ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের একটি ক্যাশ বই এবং ব্যাংক হিসাবের চেক ইস্যু রেজিস্ট্রারসহ আরো কিছু মূল্যবান কাগজপত্র। ধারণা করা হচ্ছে, এসব নথিপত্রের মধ্যেই মূল ঘাপলা লুকিয়ে রয়েছে।
নথিপত্র খোয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করে সার্কেল অফিসার (সিও) বলেন, পুলিশি ও বিভাগীয় তদন্তের ওপর নির্ভর করেই এ বিষয়ে প্রকৃত দোষীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের এক ভাগ টাকা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা চলছে। উত্তরখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কামালউদ্দিসহ চারটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাদী হওয়া এ মামলায় অডিটর জেনারেলকে ৭ নম্বর বিবাদী করা হয়। মূলত এ কারণেই সার্কেলে স্পেশাল অডিট করা হচ্ছে বলে অডিট অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়। রিটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে সার্কেলের উন্নয়নকাজ আটকে আছে। এর ওপর ভিত্তি করে গত ১৬ মে কালের কণ্ঠে 'উন্নয়ন আটকা ওয়ান পার্সেন্টে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আগামী ১০ জুন রিটের রায় হওয়ার কথা রয়েছে।
অডিট চলাকালে অফিসের মূল্যবান নথিপত্র চুরি হওয়াকে রহস্যজনক আখ্যা দিয়ে অডিট টিমের প্রধান উপপরিচালক মাহমুদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। তবে অডিট কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না কি কারণে নথিপত্র চুরির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি এবং বিভাগীয় তদন্তেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
এ চুরির ঘটনার পিছনে দুটি কারণ আছে বলে সার্কেল অফিসের একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে। একটি হলো- অফিসের ডিলিংস অ্যাসিস্টেন্ট মো. আনোয়ার হোসেনকে বিপদে ফেলা। অন্যটি হলো- বিগত দিনে করা কারো ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়া। এ ব্যাপারে আনোয়ার হোসেন বলেন, দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান এবং তাদের সহযোগিতা না করার কারণেই তাঁকে বিপদে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে এ চুরির ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এ দিকে সার্কেল অফিসের একাধিক সূত্র জানায়, অতীতে তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের উন্নয়ন নিয়ে অনেক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবছর ঘুরেফিরে এক প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অনেক ঘটনা রয়েছে। কাজ না করেও বিল তুলে নেওয়ার নজির আছে এ সার্কেলে।
পুলিশ এখনো পর্যন্ত মূল ঘটনার কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা, শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) অবনী শংকর কর। তবে এ ঘটনা নিয়ে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জিল্লুর রহমান বিভাগীয় তদন্ত করছেন। তাঁর তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আসামি গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদিকে গতকাল জিল্লুর রহমান ঘটনা তদন্তের জন্য দোলাইরপাড়ে তেজগাঁও সার্কেল অফিসে যান। তিনি পুরো ঘটনার বিবরণ শোনেন এবং তা লিখিত আকারে নেন।

No comments

Powered by Blogger.