চরাচর-বিদায় সন্ধ্যাবাতি by সাইফুল ইসলাম

এক সময় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ফুল গাছ ছিল অপরিহার্য। বাড়ির শোভা বর্ধনের পাশাপাশি এসব ফুল হিন্দুদের পূজা-আহি্নকে লাগত। তখনকার ফুলগাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বেলি, জবা, গাঁদা, গন্ধরাজ, দুপুরমণি, কাঠগোলাপ, কামিনী,


পারুল, কুঞ্জলতা ইত্যাদি। তবে এসব ফুলের মধ্যে অবশ্যই থাকত শিউলি, দুপুরমণি, সন্ধ্যামালতি। ভোর হওয়ার আগেই শিউলি ফুটে বলত, ওঠো বাঙালি_এখন ভোর হয়েছে, একটু পরই দিনমণি মুখ ফুটে হাসবে। দুপুরে দুপুরমণি ফুল ফুটে জানিয়ে দিত, চলে গেছে তোমাদের অর্ধেক দিন। এখনো দিনের অর্ধেক সময় আছে, হাতের কাজ শেষ করো তাড়াতাড়ি। দিনমণি কিন্তু বিদায় নেবে! সন্ধ্যার আগে ফুটত সন্ধ্যামালতি। এ ফুল ফুটে বাঙালিকে জানান দিত, দিনের শেষে সন্ধ্যা নামছে, এর পরই রাত, এখনই অন্ধকার নামবে_এখন তোমাদের ঘরে ফেরার পালা, বিশ্রামের পালা। সন্ধ্যামালতি ফুল ফোটার মধ্য দিয়ে শুরু হতো দিনের সমাপ্তি টানার আয়োজন। রাখাল বালকেরা হাতের বাঁশিটি কোমরে গুঁজে গোধূলি উড়িয়ে গরু-বাছুর নিয়ে বাড়ি ফিরত। কিষানিরা গরু-বাছুরকে কিছু খড়ভুসি খাইয়ে তুলে দিত গোয়ালে। ক্ষেতের কাজ শেষে ঘরে ফিরত কিষানেরা। কিশোর-কিশোরীরা তাদের ছাগল-ভেড়া-হাঁস-মুরগি গোয়ালঘরে অথবা খোঁপে তুলে দিত। যাদের হাঁসের ঝাঁক নদী-নালা, খাল-বিল থেকে তখনো ফিরে আসেনি, তারা ব্যাকুল হয়ে ছুটে যেত নদীর-খালের পাড়ে। ত্রস্ত কিশোর-কিশোরী ব্যাকুল হয়ে হাঁক ছাড়ত_আয় আয় তই তই। হাঁসের ঝাঁক থেকেও প্যাঁক প্যাঁক করে সাড়া দিত যে_দাঁড়াও, আমরা আসছি_আমরাও জানি যে সন্ধ্যা নামছে। যারা পাঠশালায় পড়াশোনা করত, তারা বাত্তিটা ঠিকঠাক করত। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে পড়তে বসার আয়োজন করত সন্ধ্যার আগেই। গৃহবধূরা দিনের কাজ সেরে নাইয়ে নিত। মসজিদ থেকে ভেসে আসত মাগরিবের নামাজের আজান ধ্বনি। হিন্দুদের ঘরে ঘরে বেজে উঠত সন্ধ্যাহি্নকের শাঁখ, উলুধ্বনি। তুলসী তলায় জ্বলে উঠত সন্ধ্যাপ্রদীপ। ঘরে ঘরে জ্বালানো হতো সন্ধ্যাবাতি। আকাশে জ্বলজ্বল করে ফুটে থাকত সন্ধ্যাতারা। লোকালয়ে একটি মধুর সন্ধ্যাভাষা সৃষ্টি করে বিদায় নিত দিন। শুরু হতো রাত। প্রদীপ জ্বালিয়ে বয়স্করা রামায়ণ, মহাভারত, বিষাদ সিন্ধু, গাজী কালু-চম্পাবতীর পুঁথি নিয়ে বসে যেত ঘরের কোণে অথবা দাওয়ায়। চণ্ডীমণ্ডব অথবা কাছারি ঘরের আঙ্গিনায় বসত যাত্রাগান, পালাগান, সঙযাত্রা অথবা গ্রাম্য বিরোধ মীমাংসার আসর। একসময় এসব কোলাহল শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ত গ্রামবাংলা। এখন আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আধুনিক হয়েছি। কখন সূর্য ওঠে আর কখন সূর্য ডোবে তার খবর রাখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি না। এখনো হয়তো কোথাও নিভৃতে ভোরের শিউলি ফুল ঝরে পড়ে। কিন্তু বাবা-মা-ছেলেমেয়েদের সকাল হয় না, তাইতো সাঁজি হাতে ফুল কুড়াতে যেতে ভোরে ওঠে না। দুপুরে দুপুরমণি ফুটলেও জানান দেয় না দিন-দুপুর হওয়ার কথা। আয়োজন করে না বিকেলে সন্ধ্যামালতি ফুল ফুটে দিনকে বিদায় জানানোর। কারণ শিউলি, দুপুরমণি, সন্ধ্যামালতি, তুলসীকে আগাছা ভেবে অথবা জমি বাড়ানোর প্রয়োজনে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি। কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে গিয়ে বিদায় করে দিয়েছি লোকব্রতকে। ভুলে গেছি সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর প্রয়োজনীয়তার কথা। ভেঙে দিয়েছি দিন আর রাতের তফাত। এখন আর সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করার তাগিদ পায় না, গৃহস্থরা ঘরে ফেরার তাগিদও অনুভব করে না। সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর প্রথা বিলোপ করে আমরা দিন আর রাত্রির তফাত ভুলে গেছি। হয়তো এর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ন্যায় আর অন্যায়ে পার্থক্য নির্ণয় করতেও ভুলে যাচ্ছি দিন দিন।
সাইফুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.