চারদিক-মনে আছে তানভীরের কথা? by মোছাব্বের হোসেন

তানভীর মনে করে, তার মা আকাশে চলে গেছেন। কেবল সেখানে যেতে পারলেই মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আর তাই তো বড় হয়ে সে হতে চায় নভোচারী। মহাকাশের অলিগলিতে খুঁজে খুঁজে মাকে বের করে আনতে চায় সে। আজ ২২ আগস্ট তানভীরের নবম জন্মদিনে এভাবেই নিজের স্বপ্নের কথা বলল সে।


আপনাদের কি মনে আছে এই তানভীরের কথা? এর জন্য অবশ্য আমাদের কিছুটা পেছনে ফিরে যেতে হবে। হাতড়াতে হবে স্মৃতির পাতা। শান্তু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা হয়তো অনেকের মনে থাকতে পারে। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর চাঁদপুর শহরের রহমতপুর আবাসিক কলোনির বাসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নুসরাত হক শান্তুকে যৌতুকের কারণে হত্যা করেন তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন সবুজ। এ কাজে সহযোগিতা করেন সবুজের বাবা-মা। তানভীরের সামনেই ঘটে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তাঁরা একে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং পালিয়ে যান তানভীরকে একা ফেলে। তখন তানভীরের বয়স মাত্র ২৭ মাস। সন্তান হারানোর বেদনায় শোকে পাথর হয়ে যান শান্তুর বাবা মজিবুল হক ও মা গুলশান আরা। শোক কিছুটা সামলে উঠে মামলা করেন তাঁরা। এরপর অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় শান্তুর পরিবারকে। অবশেষে ২০০৭ সালে তানভীরের দেওয়া সাক্ষ্যে বাবার ফাঁসি ও তাঁর দাদা-দাদির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়। এত অল্প বয়সে হত্যাকাণ্ডের হুবহু বর্ণনা শুনে সে সময়ের বিচারকসহ উপস্থিত লোকজনের কাছে বিস্ময় বালক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল তানভীর। শান্তু হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময় বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল।
আমরা সেই তানভীরের কথাই বলছি। এখন স্ট্যান্ডার্ড টুতে পড়ে সে। নানা-নানির সঙ্গে থাকে। আশপাশের আর দশটা শিশুর মতো ইচ্ছেমতো ছোটাছুটি কিংবা স্বাধীনভাবে বেড়াতে পারে না তানভীর। সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয় তাকে। এখনো নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন তার খোঁজখবর করে। কারণটাও বিচিত্র কিছু নয়। তানভীরের মা শান্তুর হত্যাকারীদের স্বজনেরা কেউ কেউ তানভীরকেও মেরে ফেলতে চান। আশপাশের এলাকাতেই তাঁরা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তানভীরের নানি গুলশান আরা বলেন, ‘সব সময় আমাদের আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। ভয়ে রাতে বাসার দরজা-জানালা খোলা হয় না। কে জানে, তানভীরকে ওরা মেরে ফেলত কি না!’ তাই তো নানা-নানি এতটুকু চোখের আড়াল হতে দেন না তানভীরকে। ‘বাসায় বসে বসে খেলনা, ভিডিও গেম, টেলিভিশন দেখা আর নানা-নানি ও একমাত্র মামা আশিককে নিয়েই সময় কাটে তানভীরের। আর তার পোষা টিয়া পাখিটা মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। এখন সে তিনটি বেড়াল পোষে। টমি, টুসি ও যমি নাম দিয়েছে তাদের। সারা দিনের একটা সময় এই বেড়ালদের খাবার দেয়, কোলে নিয়ে আদর করে। ছবি আঁকতেও ভালোবাসে তানভীর। গ্রামের শরত্কালের দৃশ্য, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, সূর্যোদয়ের দৃশ্য এঁকেছে সে। ছবি একে একে অন্যকে উপহার দেয়। মনটা মায়ের মতোই উদার। কেউ কিছু চাইলে দিয়ে দেয়। ওর মা ছিল এমন, নিজের কোনো প্রিয় কিছু কেউ চাইলে দিয়ে দিত।’ কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তানভীরের নানি গুলশান আরা। মায়ের স্মৃতি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে তানভীরের কাছে। মা কাচের জিনিস ধরতে দিতেন না—এতটুকুই কেবল স্পষ্ট করে বলতে পারছে সে। এখনো কোনো খাবার ভাগাভাগি করলে এক ভাগ আলাদা করে রাখে; মায়ের জন্য রেখে দেয় সেই ভাগটি। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আচমকা উঠে বসে তানভীর। নাতিকে শান্ত করে আবার বুকের ভেতর আগলে রাখেন নানি। অন্যের মায়েরা সহপাঠীদের স্কুল থেকে আনেন আবার নিয়ে যান, ঘুরতে যান। তানভীরের বেলায় তা আর কোনো দিনই হওয়ার নয়। আগে নানির সঙ্গে স্কুলে যেতে চাইত না, জেদ করত। আস্তে আস্তে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তার। তানভীরের নানা মজিবুল হক বলেন, ‘আমাদের এখন একটাই দাবি, হত্যাকারীর ফাঁসি দ্রুত কার্যকর হোক।’
‘জন্মদিনে কী করবে তুমি?’ এ প্রশ্নে চোখের লাল ফ্রেমের চশমাটা আঙুল দিয়ে পেছনের দিকে ঠেলে দেয় সে। দেয়ালে সাঁটানো মায়ের সঙ্গে দুই বছর বয়সের ছবিটার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, ‘বড় একটা কেক কাটব সবাই মিলে। তবে মা থাকলে অনেক মজা হতো।’
‘একবার শান্তু লুকিয়েছিল। খুঁজে খুঁজে হয়রান। এরপর তাকে পাওয়া গেল ঝুড়ির মধ্যে। সেবার তো শান্তুকে পেয়েছিলাম; কিন্তু তারপর আমার শান্তু এমন জায়গায় হারিয়ে গেল আর কোনো দিন তাকে ফেরত পাওয়া যাবে না।’ এসব কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল শান্তুর মা গুলশান আরার। নির্বিকার তানভীর নানির মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে। সন্তানকে হারিয়েছেন আগেই। তানভীর একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে, সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। তানভীরের জন্মদিনে এই কামনাই করেন তার নানা-নানি।

No comments

Powered by Blogger.