জবাবদিহি-দুর্নীতি: স্বদেশ চলেছে কোথায়? by মাহবুুবুর রহমান

দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আজ গোটা জাতিকে উদ্বিগ্ন করছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বাংলাদেশকে গত দশকে পৌনঃপুনিকভাবে পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।


কী দুর্ভাগা এ জাতি! ভাবলে অবাক হই, এই জাতিই অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি—সব পেশাজীবী, সব শ্রমজীবী মানুষ, আপামর জনগণ দুর্নীতির সঙ্গে কতটুকু জড়িত? তাঁরা তো উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন। তাঁরা কেন এর অংশীদার হবেন? তাঁরা তো দুর্নীতি করেন না। তাঁরা অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করেন না। নারী ও শিশু পাচার করেন না। হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং করেন না। এমএলএমের ব্যবসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে অর্থের পাহাড় গড়েন না।
দারিদ্র্যই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় জাতীয় সমস্যা, একটি মহামানবিক দুর্যোগ। দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধায় অন্ন জোগাড়, রোগের চিকিৎসাই জাতির জন্য আজ বড় কাজ। কর্মসংস্থানহীন বেকার কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করাই এক বড় যুদ্ধ। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। আজকে সমাজে ধনী-নির্ধনের চরম বৈষম্য।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে, স্বাবলম্বী হতে, সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তি দূর করতে আমাদের চলার পথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচন ও জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত সুশাসন। আর সুশাসন তখনই সম্ভব, যখন শাসনযন্ত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়ে জনগণ আস্থাবান হবে, নিশ্চিত হবে। গণতন্ত্রের দুই প্রধান নিয়ামক শক্তি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির শূন্যতাই আজ নগ্নভাবে প্রকাশিত। দুর্নীতির সংজ্ঞায় বলা যায়, অ্যাবিউস অব পাবলিক পজিশন ফর প্রাইভেট বেনিফিট, সরকারি অবস্থানের অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতির মধ্যে স্বভাবতই জড়িত শাসনযন্ত্রের উঁচুমহলের নীতিনির্ধারক কর্তাব্যক্তিরা। জড়িত জ্যেষ্ঠ আমলারা, বড় বড় মুনাফাখোর, অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, কর প্রতারক, ব্যাংক ঋণখেলাপিরা। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে, দুর্নীতির সংক্রমণও শুরু হয় তেমনি অতি উঁচুমহল থেকে। পানি যেমন ওপর থেকে নিচে গড়ায়, দুর্নীতিও তেমনি সব সময় অধোগামী।
জাতীয় সংসদ একটি মহান প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক পাদপীঠ, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জাতির কল্যাণে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই জাতীয় সংসদের দায়িত্ব। যাঁরা সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, তাঁদের সবার কাঁধেই এই দায়িত্ব সমভাবে বর্তায়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে তাঁরা কতটুকু আন্তরিক প্রয়াস নিয়েছেন, সংসদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে কতটুকু একনিষ্ঠ থেকেছেন? গণতন্ত্রকে সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, তার শিকড়কে গভীরে প্রথিত করতে কতটুকু সচেষ্ট হয়েছেন? ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতীয় জীবনে কতটুকু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পেরেছেন? দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রমাণসহ বিশ্বব্যাংক তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। আমরা আরও দেখেছি, এপিএসের ঘুষের টাকা কেলেঙ্কারির কারণে সাবেক রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন (পরে অবশ্য তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হয়েছেন)। এই দুটো ঘটনা দুর্নীতি হিমবাহের ভাসমান ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।
ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে। সেই সাঁড়াশি অভিযান, শক্ত আঘাত হানতে পেরেছিল ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে মহাপরাক্রান্ত বড় দুর্নীতিবাজদের। সারা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জারি করা অধ্যাদেশটি স্বীকৃতি না দিয়ে তা বাতিল করে দেয়। মন্থর হয়ে পড়ে দুদকের কর্মকাণ্ড, স্তিমিত হয়ে যায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে আক্ষেপ করতে শুনেছি, ‘দুদক এখন দন্তহীন এক ব্যাঘ্র। এর থাবার নখরগুলো ছেঁটে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও দুর্বল ও ক্ষমতাহীন করা হচ্ছে।’ হালে দুর্নীতি প্রতিরোধ অভিযান জোরদার হওয়ার পরিবর্তে দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দুর্নীতির দায়ে দায়ের করা মামলাগুলো রাজনৈতিক মামলা (শুধু সরকারি দলের) বলে খারিজ করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারালয়ে এসবের নিষ্পত্তির প্রয়োজন ছিল। আইনি বিষয়কে আইনি প্রক্রিয়ায় চলতে দেওয়া উচিত ছিল।
অবাক হই যখন মনে পড়ে, সরকারের প্রাক-নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষভাবে উল্লেখ ছিল, দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। আজ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মহান তিন মূল স্তম্ভ—আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগও বিচার বিভাগ প্রতিটি দুর্নীতিগ্রস্ত। শেক্সপিয়ারের হেমলেট নাটকে প্রিন্স অব ডেনমার্ক বলছিলেন, ‘সামথিং ইজ রোটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।’ আজ রাজকুমার বেঁচে থাকলে আর বাংলাদেশ সফরে এলে বলতেন, ‘এভরিথিং ইজ রোটেন এভরিহয়ার ইন দ্য স্টেট অব বাংলাদেশ।’ আজ বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, গোটা প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা—সবাই দুর্নীতির মহা পঙ্কিলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এ কথাগুলো আমার নয়, ১৯ মে এক সেমিনারে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। সাধুবাদ জানাই অর্থমন্ত্রীকে তাঁর সত্য ভাষণের জন্য।
মনে পড়ছে, ২০০৫ সালে একটি পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনে আমার সুযোগ হয়েছিল কানাডার পার্লামেন্ট অধিবেশন দেখার। তখন লিবারেল পার্টির পল মার্টিন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে সরকারের অর্থ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ পার্টির দলনেতা স্টিফেন হারপারের অত্যন্ত জোরালো দীর্ঘ বক্তব্য আমি শুনেছিলাম। রাজধানী অটোয়ায় তখনই গুঞ্জন উঠেছিল, সরকার টিকবে না। আমার ঢাকা প্রত্যাবর্তনের আগেই মার্টিন সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী নির্বাচনে স্টিফেন হারপার সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন।
আজ ৭ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। শোনা যায়, কালোটাকা সাদা করার সব ব্যবস্থা অতীতের মতো এ বাজেটেও থাকছে। কালোটাকা দুর্নীতির বাম্পার ফসল, অনৈতিকভাবে উপার্জিত, অবৈধভাবে গুপ্ত ও অঘোষিত এবং যক্ষের মতো রক্ষিত। সংসদ এক পবিত্র স্থান, জাতির সম্মান ও গৌরবের প্রতীক, ন্যায় ও কল্যাণের পীঠস্থান। সেখানে কালোটাকাকে সাদা করার উদ্যোগ, বৈধতা ও স্বীকৃতিদান নিশ্চয়ই অনৈতিক ও অন্যায়। বলা নিষ্প্রয়োজন, কালোটাকার বিশাল কলেবরের পুরোটাই দুর্নীতির অর্থ।
জাতীয় দুর্নীতি দমনের মহা কর্মযজ্ঞ নিষ্ঠার সঙ্গে সাফল্যমণ্ডিত করতে আমি নিচে কতগুলো সুপারিশ রাখছি:
১. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর হতে হবে। গজদন্তের পরিবর্তে আমরা ব্যাঘ্রদন্ত চাই। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আমরা দেখতে চাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও সার্বভৌম। দেখতে চাই প্রশাসনিকভাবে সুসংগঠিত, পেশাগতভাবে সুদক্ষ, নেতৃত্বের মাপকাঠিতে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, সুদৃঢ় ও সুকঠোর।
২. সব মন্ত্রী, সাংসদ, নির্বাচন প্রাক ও নির্বাচনোত্তর এবং প্রতিবছর তাঁদের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের পূর্ণ বিবরণ দাখিল করবেন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উপস্থাপন করবেন। বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে।
৩. প্রশাসনে জড়িত সব সিনিয়র আমলার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিতে হবে এবং তা প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে আপডেট করতে হবে। বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
৪. ব্যাংক ঋণখেলাপি, কর প্রতারকদের শক্ত হাতে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের নামের তালিকা নিয়মিত পৌনঃপুুনিকভাবে প্রকাশ করে জনগণের কাছে তাদের চরিত্র উন্মোচিত করতে হবে।
৫. কালোটাকার উৎস সন্ধানে দুদককে সক্রিয় ও সাহসী হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৬. দুর্নীতি দমনে গোটা জাতিকে সম্পৃক্ত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি দমনকে এক সামাজিক অভিযানে পরিণত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করা হোক জাতীয় স্লোগান। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সুনীতির পক্ষে মোটিভেশনাল পাঠ্য থাকবে।
৭. বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন রাখতে হবে।
৮. তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কাছে তথ্যপ্রাপ্তি আবশ্যকীয়ভাবে জটিলতামুক্ত, অবাধ ও সহজলভ্য করতে হবে।
৯. সংবিধানে বর্ণিত ন্যায়পালের শূন্য পদে একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রশ্নাতীতভাবে সৎ, নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে অতিসত্বর নিয়োগ দিতে হবে।
লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.