প্রতিশ্রুতি পূরণ, না চাপ সামলানো? by ফখরুল ইসলাম

মহাজোট সরকারের চতুর্থ বাজেট আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থনীতির কঠিন এক সময়ে হাসিমুখে এবার বাজেট দিতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। কারণ, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের এটাই তাঁর জন্য সর্বশেষ সুযোগ। এর পর আর তিনি এই মেয়াদে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি অর্থবছর পাবেন না।
অর্থবছর শেষ হওয়ার পর পরই নির্বাচনী হাওয়া বইবে দেশে। বাজেট প্রণয়নে সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের এই বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ব্যয়ের লক্ষ্য থাকতে পারে এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। চলতি ১০১১-১২ অর্থবছরের মূল বাজেট এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা থেকে ১৮ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ঘোষিত হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট।
নতুন অর্থবছরের জন্য রাজস্ব বা অনুন্নয়ন বাজেট ধরা হচ্ছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে অনুদান বাবদ ছয় হাজার ৫০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে সরকার ধরে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামীবার সরকারের প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর, এনবিআর-বহির্ভূত কর এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে মোট প্রাপ্তি অর্থ সংগ্রহ করা হবে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত করের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ৪০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, তারপর আমদানি শুল্ক ৩৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং আয়কর ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য আয় রয়েছে ৯৫৯ কোটি টাকা।
এ ছাড়া আগামী বাজেটে কর ব্যতীত প্রাপ্তি ২২ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা এবং এনবিআর-বহির্ভূত কর চার হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হতে পারে।
এদিকে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়ন বাজেট থাকছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি ৪৬ হাজার কোটি থেকে নয় হাজার কোটি টাকা বেশি হলেও সংশোধিত এডিপি ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে বেশি ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতি পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে। এই টাকার মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, স্বল্প মেয়াদে চার হাজার ৬০০ কোটি এবং দীর্ঘ মেয়াদে ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হতে পারে ১০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।
বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে আগামীবারের জন্য ১২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। পাওয়া না যাওয়ার শঙ্কা থেকেই আগামী অর্থবছরের জন্য তা কমিয়ে ধরা হচ্ছে বলে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্যও বার্ষিক মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ।
জিডিপির মোট আকার চলতি অর্থবছরের আট লাখ ৯৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা থেকে আরও বাড়ানো হচ্ছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। ফলে আগামী অর্থবছরে জিডিপির মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
এবারও ডিজিটাল পদ্ধতিতে, অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতা, বাজেটের সংক্ষিপ্তসার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা: একটি হালচিত্র, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথনকশা: দ্বিতীয় হালচিত্র, নারীর উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ২৫ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কার্যক্রম ইত্যাদি জাতীয় সংসদ থেকে সরবরাহ করা হবে।
একই সঙ্গে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য এডিপির একটি দলিল এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যাবলি সংসদে পেশ করা হবে।
অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে বাজেটের সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল পাওয়া যাবে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত এবং সুপারিশ পাঠানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। এসব মতামত জাতীয় সংসদে বাজেট অনুমোদনের আগে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
অর্থবিভাগ জানায়, কাল শুক্রবার বিকেল চারটায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
বাজেটে যা থাকছে: নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে আগামী বাজেটে। ব্যক্তিশ্রেণীর করহার অপরিবর্তিত থাকছে। তবে ন্যূনতম করের পরিমাণ দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। জানা গেছে, ঘন ঘন পরিবর্তন করলে রাজস্ব আদায়প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে আগামী বাজেটে, তবে ভাতা বাড়ছে না। বাড়ানো হচ্ছে রপ্তানিকারকদের উৎসে কর। বর্তমানে তৈরি পোশাকবহির্ভূত রপ্তানিকারকেরা দশমিক ৬ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা দশমিক ৭ শতাংশ হারে উৎসে কর দিয়ে থাকে। আগামী অর্থবছরে দিতে হবে ১ শতাংশ হারে।
তবে শতভাগ রপ্তানিমুখী মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিদ্যমান ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সুবিধা পাবে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, হিমায়িত পণ্য ইত্যাদির রপ্তানিকারকেরা। শতভাগ মূলধনি যন্ত্রপাতি এত দিন ১ শতাংশ বিশেষ শুল্কহার হিসেবে সুবিধা পেত।
সিনেপ্লেক্স নির্মাণে বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা রাখার প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। কম দামি ও বেশি দামি গাড়ি কেনা বর্তমানের চেয়ে ব্যয়বহুল হবে। এ জন্য সিসিভেদে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। বর্তমানে তিন বছরের পুরোনো গাড়ি আমদানি করা গেলেও, আগামীবার পাঁচ বছরের পুরোনো গাড়ি আমদানি করা যাবে।
মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকতে পারে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.