রেলে জনবল নিয়োগে জালিয়াতি-টেব্যুলেশন শিট পরিবর্তনে শিক্ষকদের কাছে ধরনা! by প্রণব বল

বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়োগসংক্রান্ত সাম্প্রতিক লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের টেব্যুলেশন শিট জালিয়াতির চেষ্টা করছেন একজন কর্মকর্তা। তিনি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া। ইতিপূর্বে শিক্ষকদের সই করা টেব্যুলেশন শিট হারিয়ে গেছে বলে নিজের ‘মনগড়া’ শিট তৈরি করে আবার সই নিতে শিক্ষকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন তিনি।


রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে নিয়োগে অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে ২৫টি পদে লোক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের জন্য সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়। গত ২২ মে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে গোলাম কিবরিয়া অন্যতম অভিযুক্ত, যাঁর বিরুদ্ধে ১১ ক্যাটাগরিতে লোক নিয়োগে অনিয়মের সরাসরি অভিযোগ আনা হয়। নিজের অপকর্ম ঢাকতে গোলাম কিবরিয়া টেব্যুলেশন শিট পরিবর্তনের জন্য এখন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের নিয়োগসংক্রান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে চট্টগ্রাম কলেজের ছয়জন শিক্ষক সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁরা টেব্যুলেশন শিটও তৈরি করে দেন। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর টেব্যুলেশন শিটে হাতে লেখা ছিল, যে শিটে ছয় শিক্ষকের সই ছিল। ওই টেব্যুলেশন শিট হারিয়ে গেছে বলে অভিযুক্ত গোলাম কিবরিয়া নিজের মনগড়া টেব্যুলেশন শিট বানিয়ে ওই কলেজের শিক্ষকদের কাছে চার দিন ধরে ঘুরছেন।
শিক্ষকেরা জানান, রেলের ১১টি পদের মধ্যে সাতটিতে মনগড়া টেব্যুলেশন শিটে সই নেওয়ার জন্য গোলাম কিবরিয়া গতকাল বুধবার বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগে আসেন। এর আগেও তিন দফায় একই শিট নিয়ে সইয়ের জন্য গেলে শিক্ষকেরা অপারগতা প্রকাশ করেন। সই নিতে গোলাম কিবরিয়া শিক্ষকদের ঘুষের প্রলোভন দেখান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গোলাম কিবরিয়া গতকাল বেলা দুইটার দিকে রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হযরত আলী মিয়ার কাছে তাঁর (কিবরিয়ার) মনগড়া টেব্যুলেশন শিট নিয়ে যান। এ সময় হযরত আলী রেলের গোলাম কিবরিয়াকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এরপর কিবরিয়া ওই বিভাগের দুই সহকারী অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র দাশ ও আলমগীর হোসেনের কাছে একই প্রস্তাব নিয়ে যান। তাঁরাও তাঁকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন।
শিক্ষকেরা জানান, এরপর কিবরিয়া রসায়ন বিভাগের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। বারবার শিক্ষকদের কাছে একই প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা করেন। বেলা আড়াইটার দিকে হযরত আলী তাঁর কক্ষ থেকে বের হলে রসায়ন বিভাগের ফটকে কিবরিয়া আবার তাঁকে মনগড়া টেব্যুলেশন শিটে সইয়ের প্রস্তাব দেন। এ সময় অন্যান্য শিক্ষকের পাশাপাশি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ও আলোকচিত্র সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এ সময় হযরত আলী মনগড়া টেব্যুলেশন শিটগুলো হাতে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিবরিয়ার উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমরা কেন আপনার আকামের সাক্ষী হব? আমরা টেব্যুলেশন শিট আগেই তৈরি করে দিয়েছি। টেব্যুলেশন শিট একবারই তৈরি হয়। সেটা কখনো পরিবর্তন করা যায় না।’ হযরত আলীর বক্তব্যের জবাবে কিবরিয়া বলেন, ‘আগেরগুলো মিসিং (হারিয়ে যাওয়া) হয়ে গেছে। তাই আবার আমি এটা করে নিয়ে এসেছি।’ এ সময় সেখানে উপস্থিত সহকারী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন কিবরিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা কোড নম্বর অনুযায়ী প্রাপ্ত নম্বর হাতে লিখে টেব্যুলেশন শিট করে দিয়েছিলাম। এই টেব্যুলেশন শিট আপনি কম্পিউটারে বানিয়ে এনেছেন।’ এ সময় গোলাম কিবরিয়ার কাছে প্রথম আলোর প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে স্যারদের সই করা শিটগুলো হারিয়ে গেছে। তাই নতুন করে ওনাদের সই নিতে এসেছিলাম। খাতাগুলো আমাদের পূর্বাঞ্চলে রয়েছে।’ এখানে সাতটি পদের শিট রয়েছে বলে তিনি জানান।
গতকালের মনগড়া টেব্যুলেশন শিটের ওপর পদের নাম উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শরীরচর্চা শিক্ষক, সহকারী কেমিস্ট, টিকিট ইস্যুয়ার। জানা গেছে, নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার পর উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন সরকারি কলেজের শিক্ষকদের। এর মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের ছয় শিক্ষক সাতটি পদের খাতা দেখে নম্বর দেন। ওই খাতাগুলোতে কোনো নাম কিংবা রোল নম্বর ছিল না। কোড নম্বর দেওয়া ছিল। এ প্রসঙ্গে খাতা পরীক্ষণের দায়িত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে গিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে এসেছি। ওখানে মূল্যায়ন শেষে টেব্যুলেশন শিটে নম্বর তুলে দিয়েছি। সেখানে কোনো রোল কিংবা নাম ছিল না। কিন্তু কিবরিয়া সাহেব যে টেব্যুলেশন নিয়ে চার দিন ধরে ঘুরছেন, সেটাতে রোল নম্বরসহ দেওয়া আছে। এটাতে সই করার জন্য পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।’ এর আগে প্রতিটি খাতা মূল্যায়নের জন্য ১৫ টাকা করে পেয়েছিলেন শিক্ষকেরা।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টা আমার কানে এসেছে। রেলের নিয়োগ নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। তদন্তের সময় হয়তো নানা কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। তাই কিবরিয়া ওখানে যেতে পারেন। এটা অনৈতিক। আমরা চাই বিষয়গুলো উদঘ্াটিত হোক।’
ঢাকায় মধ্যরাতে ৭০ লাখ টাকা কেলেঙ্কারির পর রেলের নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ২৫ ক্যাটাগরিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মে সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাসহ সাতজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। তদন্তে বাছাই ও নিয়োগ কমিটি গঠনের অস্বচ্ছতা, টেব্যুলেশন শিটে গোঁজামিল, নিয়োগে সরকারি কোটা না মানা, মৌখিক পরীক্ষার টেব্যুলেশন শিট ঘষামাজা ও নকল করার প্রমাণ মেলে।

No comments

Powered by Blogger.