ধর্ম-নৈতিক অবক্ষয় রোধে মাহে রমজান by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম নৈতিকতাহীন মানুষকে নৈতিকতা প্রদান করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইসলামের কল্যাণময় শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধ তথা চরিত্র সংশোধন। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি নৈতিক মানবীয় গুণাবলি অর্জনের জন্য ইসলাম মানব জাতিকে


দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। যেহেতু নৈতিকতাবিবর্জিত হয়ে কোনো আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, তাই উন্নত জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য ইসলামি নৈতিকতার প্রয়োজন সর্বাধিক। এ জন্য মাহে রমজানে মানুষের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, লেনদেন ও কাজ-কারবারে সিদ্ক ও সততা রক্ষার জন্য জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের সত্য কথা বলা উচিত, কেননা সত্যবাদিতা অবশ্যই পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে, আর নিশ্চয়ই পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাদার মানুষের জীবনকে যথার্থ সৌন্দর্যময় ও সাফল্যমণ্ডিত করে তার নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষের জীবনের সাধনা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জনের চেষ্টা। মনুষ্যত্বের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক বিরাজমান। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবাদিতা প্রভৃতি মহৎ গুণাবলির সমাবেশেই নৈতিকতার স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়। ধর্মপ্রাণ মানুষ যত দিন বিবেকবান হয়ে এ ধরনের আদর্শকে সমুন্নত রাখে, তত দিন মনুষ্যত্বের গৌরব বিকশিত হয় এবং ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের পরিচয় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকে। সার্থক মানুষ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ইসলামে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোজা এমন এক সবর্জনীন ইবাদত, যা রোজাদারকে সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, অন্তরের সজীবতা, হূদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা প্রদান করে। মাসব্যাপী রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা যায়। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর জন্য আল্লাহ রোজাকে ফরজ করেছেন। রোজাদার যখন রমজান মাসে রোজা রাখে, তখন সে আত্মশুদ্ধি লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)
অনৈতিকতা জঘন্যতম অপরাধ ও সব অপকর্মের মূল। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপের মূলে রয়েছে অসততা আর মানুষের জীবনে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে সততার অবসান ঘটে। যে সমাজে সত্যবাদিতা ও সততার ব্যাপক অভাব ঘটে, সে সমাজ বিপর্যস্ত হয় এবং ক্রমেই ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়। সেখানে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন প্রভৃতি স্থান দখল করে। ফলে সমাজজীবনে নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড, পাপাচার, অনাচার, অবৈধ কাজ প্রভৃতি প্রাধান্য পায়। তখন মানুষের মধ্যে নৈতিক গুণাবলি হারিয়ে যায়। এমনিভাবে মানুষ অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হলে মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়, এতে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সমাজে মানুষের সততা ও নৈতিকতার অভাবে ব্যাপক আকারে অন্যায় ও অনৈতিকতা প্রবেশ করে জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় এবং জাতীয় জীবনে নৈতিক অধঃপতনের সূচনা হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্সর্য প্রভৃতি ষড়রিপু মানব জাতির চরম শত্রু। ষড়রিপুর তাড়নায় মানুষ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। সে জন্য এসব কুপ্রবৃত্তি দমনের জন্য রোজার প্রয়োজন আবশ্যিক করা হয়েছে। কেননা মাহে রমজানে রোজাদার ব্যক্তিকে রোজাই যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে এবং সব ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত বা সংযত রাখে। ঢাল যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তেমনি রোজাও শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা পালন করবে, তার এ ঢাল ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
সামাজিক জীবনে মানুষ অসৎ হয়ে পড়লে তার ধ্বংস অনিবার্য হয়। সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার বদলে মিথ্যাচারের ফলে আদর্শ পুণ্যবান জীবনের পরিচয় মেলে না। তা ছাড়া মানুষ যদি একবার নৈতিকতা ও সততা বিসর্জন দিতে পারে তাহলে আর কোনো অবৈধ কাজই তার কাছে অনৈতিক ও সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। এ হেন নৈতিকতার অভাব থেকে সকল পাপাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং মানুষ প্রাক-ইসলামি আদিম যুগের অন্ধকার সমাজের দিকে এগিয়ে চলে। তাই মানুষের নৈতিক চরিত্র হতে হবে আদর্শবান। সদাচার ও সত্যবাদিতা হচ্ছে ইহকাল ও পরকালে সফলতা ও মুক্তির উপায়। রমজান মাসে রোজাদারদের পরচর্চা, পরনিন্দা ও মিথ্যাচার বর্জনের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অবক্ষয় রোধে রাসুলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষণা করেছেন, ‘অবশ্যই তোমরা মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকবে, কেননা নিশ্চয়ই মিথ্যা অনৈতিক কাজের দিকে পরিচালিত করে এবং নিশ্চয়ই অনৈতিক কাজসমূহ দোজখের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং মাহে রমজানে যাবতীয় অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড, অসদাচরণ, কথাবার্তা ও অবৈধ লেনদেন থেকে বিরত থাকুন এবং পরচর্চা ও পরনিন্দা পরিহার করুন। নিখুঁত ও মর্যাদাপূর্ণ রোজা হলো এই যে রোজাদার ব্যক্তি মিথ্যা বলবে না, ঘুষ খাবে না, জিনিস বাটে কোনো প্রকার দ্রব্য নেওয়ার সময় বেশি মেপে নেবে না এবং দেওয়ার সময় কম মেপে দেবে না। তৈরি খাদ্যে বা চাল, ডাল, তেল ও দুধ-জাতীয় তরল খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেবে না ও প্রতারণা করবে না। অনাথ-এতিম বা যেকোনো লোকের সম্পদ অন্যায়ভাবে জোর করে আত্মসাৎ করবে না। হত্যাকাণ্ড, ব্যভিচার, ধর্ষণ ও ছিনতাই করবে না। গিবত বা পরদোষ চর্চা করবে না। অথচ বিপথগামী মানুষ চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, দস্যুবৃত্তি প্রভৃতি নৈতিকতাবিরোধী অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ করে থাকে। এতে জনসাধারণের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় ও সমাজ কলুষিত হয়ে পড়ে। ইসলাম এসব নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং কঠোর শাস্তির বিধান করে দিয়েছে। ইসলাম ব্যভিচার ও শ্লীলতাহানির মতো নৈতিকতাবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাকওয়া, সত্যবাদিতা, ধৈর্য, আমানত রক্ষা প্রভৃতি আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় আচরণগুলো গ্রহণ করা ইসলামি নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানব জীবনকে মধুময় ও মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন যে ‘তোমরা আল্লাহর আখলাকে চরিত্রবান হও।’
ইসলামের বিধি-বিধান ও অনুশাসন মেনে চলা, সত্যপথের অনুসারী হওয়া, অপরের কোনো ক্ষতি না করা, পরোপকারের মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত হওয়া—এসবের চর্চা দ্বারাই মাহে রমজানে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। মানবিক গুণে সমৃদ্ধ চরিত্রই নৈতিক মূল্যবোধে বিকশিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তি জীবনকে উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে, তার আদর্শ সবার জন্য অনুসরণীয় হয়। সেই সমাজ হয়ে ওঠে কলুষমুক্ত এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত স্থান।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.