সাদাকালো-স্বাধীনতার সুফল কে কতটুকু পেলেন by আহমদ রফিক

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি অনেক আবেগ ঝরিয়ে শেষ হয়েছে। এখন বাকি এগারো মাস অপেক্ষা। অসুবিধা নেই। মার্চ, রক্তাক্ত আবেগের মাস। এর সংগত কারণও রয়েছে। ভাষার মাসের শেষকৃত্য সমাপনের সময় একটা কার্ড-চিরকুট হাতে এল, তাতে লেখা_'স্বপ্নভঙ্গের স্বাধীনতা : স্বাধীনতার স্বপ্ন' অর্থাৎ এ বিষয়ে কিছু একটা লিখতে হবে।


স্নেহভাজন তরুণ সাংবাদিক না, তরুণত্ব পার হওয়া সিরিয়াস চিন্তার লেখক_সাংবাদিক, তার মগ্ন চৈতন্যে আশা ভঙ্গের বেদনা, হয়তো তাই এমন চিরকুট, বলা যেতে পারে চিরকুটে প্রতিক্রিয়া। আমি তার মর্মবেদনার কারণ বুঝতে পারি। ফেব্রুয়ারির মতো মার্চও কৃষ্ণচূড়ার মাস, তার সঙ্গে একদা যুক্ত হয়েছিল শিমুল পলাশ। ফাল্গুন-চৈত্রের লাল-হলুদে মেশা রঙিন আবহ তখনকার তরুণ প্রতিবাদীদের মনে হয়েছিল বিপ্লবের প্রতীক, নিদেনপক্ষে প্রতিবাদী আন্দোলনের। তা একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। রক্তিম অভিবাদন জানিয়ে ভবিষ্যতের রক্তঝরা পথের নির্দেশনা দিয়েছিল, যা বাস্তবের ঠিকানা পায় ঊনসত্তর হয়ে একাত্তরে।
তাই ওই রোমান্টিকদের কেউ কেউ কৃষ্ণচূড়ার ফুলভরা ডাল ভেঙেছে, হয়তোবা কারো খোঁপায় গুঁজে দিতে, কিন্তু ওই রক্তিম আদর্শের ডাক মন থেকে মুছে যায়নি। তাদের কবি লেখক সঙ্গীরা কৃষ্ণচূড়ার রঙ মেখে মেখে চালান করে দিয়ে রোমান্টিকতার চরম শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু ওই রোমান্টিকতার মধ্যে বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে যেমন বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে, তেমনি ঊনসত্তরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি হয়ে একাত্তরের মার্চে। কৃষ্ণচূড়ার রঙের প্রতীকে রক্ত ঝরেছে। সেই সাতচলি্লশ আগস্ট থেকেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগোষ্ঠী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সহ্য করতে পারেনি, কিছুসংখ্যক মোসাহেব বাদে। কিন্তু ওই মোসাহেবদেরও কখনো শ্রদ্ধার চোখে দেখেনি, নিকটজন হিসেবেও নয়। ধর্মের ঐক্য সেখানে কথা বলেনি, বরং তা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রশাসনে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচারে বিষয়টা বারবার স্পস্ট হয়ে উঠেছে। এমনকি তাদের রাজনৈতিক আচরণেও বারবার তা ধরা পড়েছে। শিক্ষিত শ্রেণী বা আমজনতার সেটা বুঝতে কিছু সময় লেগেছে এই যা।
জাতীয় জীবনে পরিবর্তন ঘটানোর কালবিচারে অবশ্য সময়টা খুব বেশি নয়, মধ্য সাতচলি্লশ থেকে একাত্তরের সূচনাপর্ব। কাকতালীয় হয়েই সেটা হয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়ার মাস। গণতান্ত্রিক সব নিয়মকানুন টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে বা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্র সরলহৃদয় বাঙালি মুজিবকে আলোচনার নামে কোণঠাসা করে ২৫ মার্চ মাঝরাত থেকে রক্তস্রোতে বাঙালি নিধনের যে তৎপরতা শুরু করে, পুরো ৯ মাস এ মাটিতে সে বর্বরতার প্রকাশ ঘটিয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। বিশ্ববিবেক সহজে সাড়া দেয়নি। রাজনৈতিক স্বার্থ এমনই ভয়াবহ চরিত্রের।
পূর্বোক্ত রোমান্টিক চেতনা ও জাতীয়তাবোধের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার সারস্বত এলাকা হয়ে ওঠে তাদের অন্যতম প্রধান 'টার্গেট', 'ট্রিগারহ্যাপি' জওয়ানদের চাঁদমারি অনুশীলনের লক্ষ্যবস্তু। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনিবাসে হত্যাকাণ্ড, ছাত্রাবাসে গণকবর, গোলার আঘাতে প্রতিবাদের প্রতীক শহীদ মিনার ধ্বংসের পাশাপাশি পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হয়ে ট্যাংক আর ভারি কামানের লক্ষ্য। বাঙালি জাতীয়তার চেতনা সমূলে ধ্বংস করার চেষ্টা এবং তা কমলা লেবুর খোসা ছাড়ানোর মতো নির্লিপ্ত ভঙিমায়। পরদিন সকালে সেনা কর্মকর্তাদের অলস ব্রেকফাস্টের বিবরণে তেমনটাই প্রকাশ পেয়েছে। ফুটে উঠেছে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা, ক্রোধ ও অবজ্ঞা। মেজর সিদ্দিক মালিকের লেখা তেমন সত্যই তুলে ধরেছে।
সত্যই ২৫ মার্চ রাতে এবং পরদিনও হত্যালীলার কাজটা পরিকল্পনামাফিক শেষ করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পুরনো ঢাকার বিশেষ বিশেষ মহল্লা যেমন নয়াবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার এলাকার ধ্বংসযজ্ঞ ওই নৃশংসতার প্রমাণ। আর এই বর্বরতার ঘটনা যাতে বিশ্বের চোখে ধরা না পড়ে, সেজন্য চতুর পাকিস্তানি-গোয়েন্দারা ঢাকার পাঁচতারা হোটেল থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের পোটলা বেঁধে হাওয়াই জাহাজে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কপাল মন্দ। এই চেষ্টায় সামান্য ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। তা হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার মোটামুটি খবর দক্ষিণ এশিয়া হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে পেঁৗছে যায়। রাজনৈতিক স্বার্থপরতা নির্বাক থাকলেও সংবাদপত্র মহলে ঝড় ওঠে। এমন সব ঘটনার 'খবর' তো আর বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায় নিজেদের মাটিতে সে দেশের সেনাবাহিনীর হাতে সংঘটিত বর্বরতার খতিয়ান জেনে। কিন্তু রাজনৈতিক শিবির বিভাজনের কারণে কোথাও এ বর্বরতা দাগ কাটে, কোথাও কাটে না। রাজনৈতিক মতাদর্শ তখন স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়। চৈনিক সমাজতন্ত্র তার প্রমাণ। নিরীহ মানুষের রক্তস্রোত তাদের চেতনায় দাগ কাটেনি।
সে রাতে ঢাকায় রক্তের উৎক্ষেপ এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, তা কৃষ্ণচূড়ার রোমান্টিক লাল পাপড়ি আরো লাল করে তোলে। পরে ওই বর্বরতার প্রকাশ ঘটে শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে। এবং তা এতটা নিষ্ঠুরতায় যে ভীত-আতঙ্কিত মানুষ একসময় অস্ত্রহাতে ঘুরে দাঁড়ায়। বিকল্প কোনো পথ তখন আর খোলা ছিল না। 'সব লাল হো যায়েগা'র মতো ঐতিহ্যবাহী' আহ্বান বুঝি স্নায়ুকোষে বাজতে থাকে। ওই রক্তের ছিটে তরুণ হৃদয়ে এতটাই আঘাত করে যে দল-মত ভাবনা একপাশে সরিয়ে দিয়ে তারুণ্যের যাত্রা শুরু রণক্ষেত্রের দিকে। লক্ষ্য আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবিলা এবং বর্বর সামরিক শক্তির পরাজয় নিশ্চিত করা। এখানেও তারুণ্যের রোমান্টিকতা কোথাও কোথাও কথা বলে : 'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।'
২৬ মার্চ কালো রাতে সূচিত গণহত্যার প্রতিক্রিয়া তারুণ্যের রোমান্টিক আবেগ আর বয়স্কের ধীরস্থির বিচার-বাস্তবতা একসঙ্গে মেশে এমন প্রত্যয়ে যে, 'রক্তের ঋণ রক্তেই হবে শোধ' বিষণ্নমুখ তো তরুণকে মহল্লার অলিগলিতে ঘুরতে দেখেছি তাকে আর দেখতে পাই না। একসময় জানা যায়, সীমান্তের ওপারে তার ঠিকানা। স্বাধীনতাযোদ্ধার আবেগ শাণিত ইস্পাত-কাঠিন্যে নতুন মাত্রা পায়। দেশের মাটিতে কথিত বন্দিশিবিরে থাকা মানুষের বড়সড় অংশেও হত্যা ও ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধের শপথ যোদ্ধার ভাষা পেয়ে যায় : 'আজীবন বয়ে যাবে বিদীর্ণ স্বদেশে, স্বজনের লাশের আশেপাশে।' শোক নয়, কান্না নয়, হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে প্রতিরোধের 'জমাট আগ্নেয়শিলা। যে শিলা অন্তিম প্রতিজ্ঞায় অস্ত্র হতে জানে।' তাই রাজনীতির এমন ধারণা ভুল যে যুদ্ধ শুধু সীমান্তের ওপার থেকেই হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ যেমন চলেছে রণাঙ্গনে, এবং তা দেহাতি মানুষেরও তৎপরতায়_কবির ভাষায় 'লাঙল ফেলিয়া বাহে, এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম' তেমনি যুদ্ধ চলেছে স্বাধীনচেতা মানুষের ঘরে ঘরে, মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে নানামাত্রিক সহযোগিতায় যেজন্য বন্দিশিবির হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের দুর্গ। তখন স্বাধীনতার পক্ষে ঘর-বাহির একাকার।
তেমনি একাত্তরের জানুয়ারি থেকে মার্চ_ঢাকার রাজপথে প্রতিদিন যাঁরা মিছিলে চেহারা দেখেছেন, স্লোগান শুনেছেন তাঁরা ভালোভাবেই জানেন, ছাত্রদের পাশে সে মিছিলে জায়গা করে নিয়েছিল বস্তিবাসী মানুষ, বাঁশের লাঠি আর দাঁড়-বইঠা হাতে সাধারণ মানুষ_দিন এনে খেটে খাওয়া মানুষ। ঠিক তা লক্ষ করেছে পাকিস্তানি বাহিনীর পর্যবেক্ষক চোখ। তাই মার্চের হত্যাকাণ্ডের সূচনায় ওদের হিংসার আগুনে পুড়েছে রেললাইনের পাশে দাঁড়ানো বস্তিগুলো। ঝুপড়ি থেকে সবাই বেরোতেও পারেনি। ওই নিষ্ঠুরতা তুলনাহীন। ২৭ মার্চ নিষ্ঠুরতার এ ছবিটা দেখেছি।
আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে একটি অপ্রিয় সত্য স্বীকার করতে হয়, শুরুতে বাঙালি কর্মকর্তা তথা অফিসার অনেকের মধ্যে দ্বিধা, সংশয়, ভয় উপস্থিত ছিল_ছিল না সাধারণ সৈনিক তথা জওয়ানদের মধ্যে। হয়তো এর কারণ ওই সাধারণরাই, অফিসার বিশেষত অবাঙালি অফিসারদের অবজ্ঞা অবহেলার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। বাঙালি হওয়ার কারণে বিজাতীয় হিসেবে অনেক অমানবিক আচরণ হজম করতে হয়েছে তাদের। ষাটের দশকে একাধিক বাঙালি জওয়ানের মুখে এ ধরনের কথা শুনেছি।
তাই 'আর্মি-নেভি-এয়ারফোর্স' তো বটেই ইপিআর জওয়ানদের মধ্যেও ছিল তীব্র অবাঙালি বিদ্বেষ-বিরূপতা। স্বভাবতই ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী চেতনা তাদের স্পর্শ করে কিছুটা অধিক মাত্রায়। এ ক্ষেত্রে শ্রেণীগত দিকটাও বিবেচনার দাবি রাখে। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাদের চাকরির প্রতি আকর্ষণের অন্যতম কারণ, তদুপরি ক্ষমতার বিষয়টা তো আছেই। জওয়ান বা সে স্তরের কর্মচারীদের তা ছিল না। তদুপরি বাঙালিত্বের যন্ত্রণা। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বলে, ২৫ মার্চের পর কিছুসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে ইপিআরসহ সামরিক বাহিনীর জওয়ানরাই স্বাধীনতা-যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে অগ্রচারীর ভূমিকা পালন করেন। অনেক ক্ষেত্রে অফিসারদের বাধ্য করেন পাকিস্তানি বাহিনী ছেড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে। আর দ্বিধান্বিত বাঙালি অফিসারদের অসহায় করুণ মৃত্যুর কথাও আমরা জানি। তাঁরা ভাবতেই পারেননি তাদের অবাঙালি সহকর্মীরা বিনা অপরাধে ঠাণ্ডা মাথায় নির্বিচারে তাদের খুন করতে পারে।
স্বাধীনতাযুদ্ধের চরিত্রগত এ দিকটা অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই এ দিকটা অন্ধকারে রাখা হয়েছে। আমরা চাই, স্বল্পালোচিত এ অধ্যায়ের উদ্ঘাটন, যাতে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক কথায় স্বাধীনতাযুদ্ধে নিম্নবর্গীয়দের ভূমিকা, নির্দলীয় তরুণদের ভূমিকা যাতে যথাযথ গুরুত্বে উত্থাপিত ও লিপিবদ্ধ হয়। তখন এটাও স্পষ্ট হবে, স্বাধীনতার সুফল তারা কতটুকু পেয়েছে। প্রায়ই পত্রিকায় দেখি আটপৌঢ়ে মুক্তিযোদ্ধার দুঃখ-দুর্দশার বিবরণ রিকশাটানা বা দিনমজুর বা কর্মহীন দুস্থ, রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার করুণ কাহিনী প্রায়ই কাগজে ছাপা হয়। এখন প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার সুফল কে কতটা পেলেন। বিশেষ করে মার্চ বা ডিসেম্বরে সাংবাদিকতার চমক সৃষ্টিও বোধ হয় সেসব ক্ষেত্রে কাজ করে। স্বাধীনতাযুদ্ধের এ ইতিহাস ভিন্ন ইতিহাস_লেখা হয়নি, কিন্তু লেখা হওয়া উচিত। তরুণ গবেষকদের এ শ্রমসাধ্য কাজে এগিয়ে আসা দরকার এবং সেটা বাঙালি জাতিচেতনার স্বার্থে, সেই সঙ্গে শ্রেণীচেতনার প্রতি সুবিচারের জন্যও বটে।

লেখক : ভাষাসৈনিক, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.