সম্পদের হিসাব বনাম ক্ষমতার মাত্রা ও প্রহসন by লুৎফর রহমান রনো

নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা ছোটকাল থেকে শুরু না হলে পরে আর সুযোগ থাকে না। কঠোর আইনকানুন প্রয়োগ করে জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে অপরাধপ্রবণতা নির্মূল করা তো সম্ভব নয়ই, হ্রাস করাই কঠিন। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নীতিশিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি কিংবা সৃষ্টিশীল সংবেদনশীল মানুষরূপে গড়ে তোলার


অনুষঙ্গগুলো অনুপস্থিত_কথাটা খুব সত্য। তবু নূ্যনতম 'ভালো মানুষ' হওয়ার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য_এই বোধ জাগ্রত ছিল আমাদের সুপ্ত চেতনায়, সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক নৈরাজ্য আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে, সমাজজীবনে মূল্যবোধ ধ্বংসের বিষ ছড়িয়ে দেয়।
জাতীয় রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা। যে ক্ষমতা জীবনের সব ক্ষেত্রে কামিয়াব হওয়ার পথ পাইয়ে দেয় একে একে। ক্ষমতার ষোল আনাই অপব্যবহার করে অর্থ-ঐশ্বর্য লাভ করা যায়। আইন-কানুনের ঊধর্ে্ব ওঠে গেলে এমন কোনো অপরাধ নেই যে তা করা থেকে কোনো ব্যক্তি বিরত থাকবে, যদি তার প্রয়োজন পড়ে। তাই রাজনীতি দেশসেবা, জনসেবামূলক নিঃস্বার্থ এক মেধাদীপ্ত শান্তিকামী সংগ্রাম হিসেবে যে পরিচিতি ছিল তা বিলুপ্ত হলো। এর পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হলো রাজনীতিতে আত্মপ্রতিষ্ঠা শুধু নয়, ইচ্ছে করলে পথ থেকে বা শূন্য থেকে ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠা যায়, যদি সাহসী কর্মী-নেতা হওয়া যায়, খুনি ক্যাডার হওয়া যায়। এসব গুণ নিয়ে ঢালাও সংসদ সদস্য পদসহ অনায়াসে ক্ষমতাকেন্দ্রের খুব কাছাকাছি পদে, পরিসরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় এবং সব ধরনের সুবিধা ভোগ নিশ্চিত হয়। এই ভয়ঙ্কর হাতছানির কালো ছায়া দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সম্পূর্ণ শিক্ষা ক্ষেত্রকে ওলট-পালট করে দিল।
রাষ্ট্রের ওপর তলায় অপরিসীম দুর্নীতির অবাধ সুযোগ আর কিশোর-তরুণদের মাথা-মগজে রাজনীতির প্রলুব্ধকর উচ্ছ্বাস একাকার হয়ে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের স্খলন অনিবার্য হয়ে উঠল। এরই ধারাবাহিকতায় সাংসদ হওয়ার যোগ্যতা যে পর্যায়ে এসে দাঁড়াল তা না বলাই ভালো। আর এখন টাকা কামানোর সহজ পথ এই ক্ষমতার লোভে ব্যবসায়ীরাও ঢালাও খরচপাতি করে সংসদ ভবনের টিকিট পেতে চান। সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ক্যাডার হয়ে ওঠে ডাকসাইটে ব্যবসায়ী, এমনকি সাংসদও হতে পারছে। এই যখন আমাদের সাংসদ-মন্ত্রী হওয়ার পথ ও পাথেয়, এখানে সম্পদের হিসাব দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে কি সম্পদ আত্মসাতের লোভ দমন করা সম্ভব? চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীরও আইনে সাজা হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই বলে এ রকম অপরাধ কি কমছে? স্থান-কাল-পাত্র ও পদ্ধতি ভিন্নতর মাত্র, তা ছাড়া একই অবস্থা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সম্পদের হিসাব চাওয়া হবে বলে অঙ্গীকার ছিল। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেলে শোনা গেল নির্বাচন কমিশন যখন সম্পদের হিসাব নিয়েছে তাহলে আর তার দরকার পড়বে না নতুন করে চাওয়ার। এর মধ্যে সংসদ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেল। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা হলো সাংসদদের হাতে। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বিভিন্ন সময় নানা প্রক্রিয়ায় এর প্রতিবাদ জানালেও পরিবর্তন করা হলো না। সাংসদদের দামি গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো। রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ জনগণের কথা চাপা পড়ে যায় অনেক সময় সাংসদ-মন্ত্রীদের চাওয়া-পাওয়া মেটাতে। রাষ্ট্র যখন সাংসদ-মন্ত্রীদের সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা প্রদান করে অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় অর্থ অপচয় করে, অন্যদের প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টানাটানি করে তাঁদের হয়ে তখন দেশের মানুষ এসব সম্মানিতদের নিয়ে কী ভাববে! প্রতি মুহূর্তে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংসদ-মন্ত্রীদের ক্ষমতা এবং মর্যাদার খবর ও দৃশ্য উপচে পড়ে। রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠানের এসব বিধিপদ্ধতি তৈরি হয়েছেই সাধারণ মানুষকে মনস্তাত্তি্বকভাবে শাসন করার নিমিত্তে। তা না হলে একজন কৃতি শিক্ষক, ছাত্র বা বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক দার্শনিকের কীর্তি বা গুণগান প্রচারমাধ্যমে এমন অদৃশ্য হয়ে থাকত না। সামাজিক মূল্যবোধের ভাঙা-গড়া এভাবেই ওপর থেকে করা হয়, চাপিয়ে দেওয়া হয়, মন্দকে ভালো আর ভালোকে মন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এখন সম্পদের হিসাব চেয়ে রাষ্ট্র বা সরকার এ বিষয়টি বোঝাতে চায় যে তারা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের সুযোগ দেবে না। হাস্যকর বটে! হিসাব দেওয়ার ভয়ে বা হিসাব দিতে গিয়ে গরমিল ধরা পড়ে গেলে অসম্মান হওয়ার আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের লোভ-লালসার লাগাম টানা যায় না। আর যাঁরা দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, যাঁরা নিজেরা আইন প্রণয়ন করে এবং তাঁরাই তা অমান্য করার মতো দাপট দেখিয়ে বহাল তবিয়তে থাকে, তাঁদের বেলায় সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধি কি কোনো বাধা হতে পারে? জনগণ বরং দেখতে চায় এ পর্যন্ত বর্তমান ও আগেকার সরকারের যেসব সাংসদ-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অবৈধ সম্পদ লাভের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচার কি হচ্ছে? দুদককে তো ক্ষমতার প্রাথমিক আঘাতেই স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় শতশত দাগী অপরাধী মুক্তি বা জামিন পেয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে না। তাহলে হিসাব নেওয়া হবে কেন, যদি তা গোপনীয় থাকে? বোঝা যাচ্ছে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে। দেশ-জাতি-আইনকানুন-নীতি-নৈতিকতা-সততা সবকিছুই পরাস্ত হয়ে পড়ল ক্ষমতাবানদের কাছে! এসব দেখে-শুনে বলতে হয়, সম্পদের হিসাব চাওয়া নয়, ক্ষমতার মাপ ও মাত্রার হিসাবটা কী ভয়াবহ, সেটিই আমরা উপলব্ধি করছি। কী নিদারুণ প্রহসন।

লেখক : সাংবাদিক
ronokk 1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.