শক্তিশালী স্থানীয় সরকার সংস্থাই কাম্য-ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে উপজেলা

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চার স্তরবিশিষ্ট শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সেই লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব গ্রহণ জনমনে আশা জাগিয়েছিল।


কিন্তু দেড় বছর ধরে পরিষদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছে তাতে নির্বাচকমণ্ডলী তো বটেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও—এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে স্থানীয় সরকার সংস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির কার্যকরতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
উপজেলা পরিষদের সঙ্গে সাংসদদের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। মূলত সাংসদদের অনাগ্রহ ও বিরোধিতার কারণেই ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। বিগত আওয়ামী লীগের সরকার উপজেলা পরিষদ আইন পাস করলেও নির্বাচন করেনি। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়িত হয় মহাজোট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর।
সবার প্রত্যাশা ছিল, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আইনানুসারে পরিষদের কার্যপ্রণালিবিধি ঠিক করতেই অনেক সময় চলে যায়। শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সরকার ১০টি মন্ত্রণালয়ের যে ১৩টি বিভাগ উপজেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাও কার্যকর হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, কোনো ফাইল তাঁদের কাছে পাঠানো হয় না। সাংসদ নিজেই নাকি নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে ফাইলে সই করিয়ে নেন। এ অবস্থায় তাঁরা আগামী ২ অক্টোবর জাতীয় সম্মেলন ডেকে আন্দোলনে নামারও ঘোষণা দিয়েছেন।
উপজেলাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় কমিটি বলেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হবে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। ছুটিছাটাও নিতে হবে তাঁদের কাছ থেকে। এ সিদ্ধান্তে বেঁকে বসেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এমনকি তাঁরা গণপদত্যাগেরও হুমকি দিয়েছেন বলে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে উপজেলা পরিষদ জনগণের সেবাপ্রতিষ্ঠান না হয়ে বিরোধের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেউ আইনের ধার ধারছেন না। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছেন। সাংসদ উপজেলা পরিষদের কাজ তদারক করতে পারেন; হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের কাজ হবে পরিপূরক; প্রতিযোগিতামূলক নয়। সাংসদকে পাশ কাটিয়ে যেমন এলাকার উন্নয়ন হতে পারে না, তেমনি সবকিছু তাঁর হাতের মুঠোয় রাখাও বাঞ্ছনীয় নয়। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবশ্যই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। জনগণের সার্বভৌমত্বকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। আশা করি, উপজেলা পরিষদকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ত্রিমুখী বিরোধের দ্রুত সন্তোষজনক সমাধান হবে। স্থানীয় সরকার সংস্থা হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.