'রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত'

জাতীয় সংসদ ও আদালতের মধ্যে তর্কবিতর্ক অসৌজন্যমূলক। এ ধরনের বিতর্ক দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। রাষ্ট্রের দুই প্রধান অঙ্গের মধ্যে এ ধরনের বিতর্ক দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিক, আইনজীবীসহ বিশিষ্টজনরা।


তাঁদের মতে, আদালত ও সংসদের মুখোমুখি অবস্থান রাষ্ট্রের জন্য একটি অশনিসংকেত। দেশের জন্য এটা মঙ্গলজনক নয়। এ ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এর কারণে অস্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। বিশিষ্টজনরা আরো বলেছেন, রাষ্ট্রের এই দুই সাংবিধানিক অঙ্গের নিজ নিজ এখতিয়ার চর্চার ক্ষেত্রে আরো অধিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও সহনশীলতা দেখানো প্রয়োজন।
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের বেঞ্চ বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করেন। হাইকোর্টের এসব মন্তব্য জানাজানি হলে ওই রাতেই জাতীয় সংসদেও বিচারপতি তথা বিচার বিভাগ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়।
জাতীয় সংসদে উচ্চ আদালত সম্পর্কে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের মন্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল- বলেন হাইকোর্ট। আদালত স্পিকার সম্পর্কে বলেন, তিনি অজ্ঞ ও বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করেছেন। স্পিকারের বক্তব্য 'অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী' বলেও উল্লেখ করেন আদালত। হাইকোর্ট বলেন, একই সঙ্গে বারের একজন সদস্য হিসেবে বিচার বিভাগ সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্য করায় স্পিকারের আইনজীবী সনদ রাখা যায় কি না তা নিয়েও ভাবতে হবে। হাইকোর্ট স্পিকার সম্পর্কে আরো বলেন, তাঁর বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। স্পিকার তাঁর পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। ওই পদে থাকার অধিকার তাঁর নেই। পরে মঙ্গলবার রাতেই জাতীয় সংসদে সদস্যরা আদালতের মন্তব্যের সমালোচনায় ফেটে পড়েন। সংসদ সদস্যরা বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে তিন দিনের আলটিমেটাম দেন। তাঁরা বিচারপতিকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান।
সড়ক ভবনের জমি সুপ্রিম কোর্টকে ফিরিয়ে না দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা আদালত অবমাননা মামলার শুনানির সময় মঙ্গলবার হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভিন্ন মন্তব্য করেন। এর আগে গত ২৯ মে রাজধানীর সড়ক ভবনের জমি সুপ্রিম কোর্টকে ফিরিয়ে দিতে আদালতের আদেশ নিয়ে জাতীয় সংসদে এক বিতর্কে অংশ নিয়ে স্পিকার বক্তব্য দেন। এ বিতর্কে দুজন সংসদ সদস্যও অংশ নেন। স্পিকার ওই দিন বলেছিলেন, 'আমি যদি মনে করি সংসদই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, সরকার যদি মনে করে তারাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, আবার আদালত যদি মনে করেন যা ইচ্ছা তা করবেন- এটা ঠিক নয়। কোর্টের বিচারে জনগণ যদি ক্ষুব্ধ হয়, তা হলে বিচারকের বিরুদ্ধে একসময় রুখে দাঁড়াতে পারে। এমনিভাবে সরকারও যদি জনগণের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে, জনগণ একদিন সরকারের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে। এ ধরনের ইতিহাস আছে।'
স্পিকার আরো বলেছিলেন, দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, এটি ভালো দেখায় না।
এসব ঘটনা নিয়ে গতকাল বিচার বিভাগ ও সংসদ মুখোমুখি অবস্থানে বলে দেশের পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর প্রতিক্রিয়া জানান বিশিষ্টজনেরা।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, কারোরই এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যাতে একটি অঙ্গ অপর একটি অঙ্গকে আঘাত করে। পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান অবস্থার গণতান্ত্রিক সমাধান প্রয়োজন। তিনি বলেন, সংসদ হলো সংবিধানের মূল স্তম্ভ। সেখানে ১৬ কোটি মানুষের আস্থাভাজন প্রতিনিধিরাই রয়েছেন। জনগণের প্রতিনিধিরাই সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়- সংসদের এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। এটিও তিনটি মূল স্তম্ভের আরেকটি। যারা শতভাগ সাংবিধানিক শাসনে বিশ্বাস করে, তারা চায় একটি অঙ্গ আরেকটি অঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুক।
ড. কামাল বলেন, 'সাংবিধানিক শাসন আমরা সবাই চাই। সংবিধানকে সমুন্নত রাখার মাধ্যমে এই শাসন সব সাধারণ মানুষ চায়। আশা করি যে সমস্যাটি হয়ে গেল, বিচার বিভাগ ও আইন পরিষদ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রেখে সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যাবে।'
উদ্ভূত পরিস্থিতির যাতে সুষ্ঠু সমাধান হয় সে জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, আপনারা এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করবেন না যাতে সমস্যাকে আরো গুরুতর করে তোলে। তিনি বলেন, যেকোনো সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত সাংবিধানিকভাবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির সাংবাদিকদের বলেন, 'রাষ্ট্রের প্রধান দুটি অঙ্গ সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে অহেতুক সংঘাত শেষ না হলে সামনে সবার জন্যই খারাপ দিন আসছে। দুটি অঙ্গে যদি এভাবে অহেতুক ঝগড়া লেগে যায়, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?' তিনি বলেন, 'আমি বলব এটা খুবই দুঃখজনক। আমি এটাকে একটা অশনিসংকেত হিসেবে দেখছি।' তিনি বলেন, 'এখানে অহেতুক সংঘর্ষ লেগেছে। আমার মনে হয়, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে এই সমস্যার এখনই সমাধান করা উচিত।' তিনি বলেন, 'আমাদের দেখতে হবে গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে থাকছে কি না। গণতন্ত্র অর্থ শুধুই নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র অর্থ সংবিধানের শাসন। যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইতিমধ্যে গণতন্ত্র চলে গেছে (ডেমোক্রেসি হ্যাজ অলরেডি গন)।'
সরকার সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রজাতন্ত্রের এ দুটি বিভাগই সার্বভৌম এবং প্রজাতন্ত্রের স্তম্ভ। এ দুটি সাংঘর্ষিক হোক এটা আমরা কখনোই চাইব না। সংসদ ও বিচারকদের কাছে রাজকীয় আচরণ এবং রাজকীয় ভাষা প্রত্যাশা করি। যার যার ক্ষেত্রে তারা সার্বভৌম এবং সেই জায়গায় কেউ কারো সাংঘর্ষিক হবে না, এটাই প্রত্যাশিত।'
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বিচারপতিদের কাছ থেকে বিচারিক ভাষা এবং সাংবিধানিক বক্তব্য প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেন, আদালত ও সংসদকে এমন ভাষা প্রয়োগ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ ও আইনজীবীরা অন্য কোনো মনোভাব পোষণ না করেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ বলতে সবাইকে বোঝায়। এখানকার বিষয়টি একজন বিচারপতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন বিচারপতির কর্মকাণ্ডকে ঢালাওভাবে বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা ঠিক না। সে জন্য সব কোর্টকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যায় না। তিনি বলেন, 'সংসদ যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চেয়েছে, এখন তারা ইচ্ছা করলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ প্রধান বিচারপতিকে লিখতে পারে। এ ধরনের দরখাস্ত করলে প্রধান বিচারপতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজন মনে করলে এটাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণ করতে পারেন। এটাই হলো আমাদের সংবিধানের বিধান।' তিনি বলেন, 'আমাদের বিচারপতিদের বক্তব্য-আচরণ হতে হবে বিচারিক, ভাষা হতে হবে সংবিধানসম্মত। যাঁরা বিচার করেন তাঁদের অবশ্যই বিচারিক মনোভাব নিয়ে বক্তব্য দিতে হবে।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও সংসদের স্পিকারের মধ্যে যেসব কথা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে এটা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। এমন ক্ষতি, যা কোনো স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। সরকার বিচার বভাগ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্তরে দলীয়করণ করেছে। এখন বিচার বিভাগকে ধ্বংস করার শেষ উদ্যোগ নিয়েছে।
এম কে আনোয়ার আরো বলেন, 'স্পিকার উচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, এতে অন্যায় কিছু আমি দেখি না। রায়ের বিশ্লেষণ করা অন্যায় নয়।' তিনি বলেন, সরকার এমন লোকদের বিচারক বানিয়েছে, সেই লোকরাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। স্পিকারের মন্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলাটা সমীচীন হয়নি। কারণ সংসদ সার্বভৌম। একমাত্র সংসদই আদালত সম্পর্কে কথা বলতে পারে। কিন্তু এই সরকার বিচার বিভাগকে এত দলীয়করণ করেছে যে, সরকারপক্ষ যতই হুমকি দিক না কেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তবে দেশের বিচার বিভাগ ও সংসদ নিজ নিজ এখতিয়ার নিয়ে থাকবে। তা হলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দলের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতির মন্তব্য ও সংসদ সদস্যদের তীব্র প্রতিক্রিয়াকে দেশের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিচারকরা এখন সরকারের ওপরই সওয়ার হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট ও সংসদে যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অস্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, যা গণতান্ত্রিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের এই দুই সাংবিধানিক অঙ্গের নিজ নিজ এখতিয়ার সম্পর্কে জানতে হবে। এখতিয়ার চর্চার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এক বিবৃতিতে বলেছেন, মামুলি বিষয় নিয়ে জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিতর্ক অসৌজন্যমূলক। এটি দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার অকার্যকারিতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না বলে বিবৃতিদাতারা আশা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.