কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা by একেএম সালাহউদ্দিন

কৃষিপ্রধান আমাদের এই বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতির চাবিকাঠি এই কৃষি দেশীয় জিডিপির শতকরা প্রায় ২২ ভাগ বহন করে আসছে। অর্থনীতির চাকা বেগবান করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যেমন_ দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, তদুপরি খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।


বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১-এর গণনা-পরবর্তী যাচাই জরিপের (পিইসি) চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি ৮০ লাখ। যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০০ জনেরও অধিক লোক বসবাস করে এবং ২০১১ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে প্রজনন হার ২.৩। শিক্ষার অভাব ও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগই ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে (ভূমিহীন বলতে যাদের পরিমাণ ০.০৫ একরের কম তাদের বোঝায়)।
বাংলাদেশে অপুষ্টিহীনদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। সমাজে নারীদের প্রতি হীন দৃষ্টিভঙ্গি, অশিক্ষা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই নিম্নমানের জীবনযাপন করে। এতে বাংলাদেশে প্রতি বছরই শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শিশু জন্মের সময় অপুষ্টিজনিত নানা রোগ নিয়ে জন্মে থাকে। ১৯৭০ সালে এদেশের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, কিন্তু বর্তমানে এর পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেয়ে শতকরা ৫০ ভাগে নেমে এলেও এখনও তা সহনীয় পর্যায়ে পেঁৗছায়নি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ দানাজাতীয় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে দানাজাতীয় খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন ছিল ১১.৪ মিলিয়ন টন। পরবর্তী সময় ২০০৩ সালে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৯ মিলিয়ন টনেরও বেশি।
এদিকে প্রতি বছরই গম, ডাল, ভোজ্যতেল, মসলাসহ নানা খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে আমদানি করতে হয়। ডাল জাতীয় খাদ্যের মোট চাহিদার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া দেশে কেবল শতকরা ৩৪ ভাগ ভোজ্যতেল উৎপাদন হয়ে থাকে। বাকিটা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। বার্কের (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল) তথ্যানুসারে, ২০১৫ সাল নাগাদ ১.২ মিলিয়ন টন শুধু দানাদার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হলেও সামগ্রিকভাবে খাদ্য ঘাটতি রয়েই যাবে।
দেশে প্রাণিজ আমিষের (প্রোটিন) ঘাটতি মেটাতে মৎস্যসম্পদ বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৯৯৪-৯৫ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ১.১৭ মিলিয়ন টন। পরবর্তী সময় ২০০৩-০৪ সালে এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২.১০ মিলিয়ন টনে। বিগত দশ বছর ধরে মাছের পাশাপাশি মাংস, দুধ, ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা দেশের মোট চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। 'ফাও' (ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন)-এর এক জরিপে দেখা যায়, যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২৮ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ খাওয়া প্রয়োজন, সেখানে এদেশের মানুষ গড়ে গ্রহণ করছে দৈনিক মাত্র ২ গ্রাম। দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ খাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও গড়ে এদেশের মানুষ গ্রহণ করে মাত্র ৩০ মিলিলিটার করে।
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করলে কৃষির বিকল্প অন্য কিছু চিন্তাও করা যায় না। একমাত্র এই কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর এই কৃষির উন্নতিকল্পে কৃষক থেকে শুরু করে কৃষিসংশ্লিষ্ট সবাইকে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত কাজ করতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ব্যবস্থা, সময়মতো উন্নত বীজ, সার, সেচের পানির নিশ্চিতকরণ ও শস্যবীমা প্রকল্প চালু করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানেরও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষির উন্নয়ন অত্যাবশ্যক।

স শিক্ষার্থী, শেরেবাংলা কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
লড়লংধঁ@মসধরষ.পড়স
 

No comments

Powered by Blogger.