ভারত-মনমোহন রাষ্ট্রপতি এবং রাহুল প্রধানমন্ত্রী! by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

রাহুল গান্ধী যে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এ কথা মাঝে মধ্যেই ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে থাকেন। যেমন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় কিছুদিন আগে বলেছেন, রাহুলের প্রধানমন্ত্রী হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। ড. মনমোহন সিংয়েরও এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। তিনি নিজেও জানেন, তার বয়স হয়েছে।


দল ও নেতৃত্বের মধ্যেও সম্পর্ক এখন ক্রমশ তিক্ত হচ্ছে। নতুন, তরুণ নেতৃত্বকে জায়গা করে দেওয়া এখন কংগ্রেসের ভালোর জন্যই দরকার।
রাহুলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি তার ৪১তম জন্মদিনে সম্প্রতি উস্কে দিয়েছেন নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক দিগ্গি্বজয় সিংহ। তিনি দিলি্লতে বলেছেন, রাহুল এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সর্বতোভাবে তৈরি। কিন্তু কবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এ কথা কিন্তু বলেননি। লোকসভা নির্বাচনের তো আরও দু'বছর দেরি। দ্বিতীয়ত, আগামী লোকসভা নির্বাচনও কংগ্রেসের পক্ষে খুব স্বচ্ছন্দ হবে না বলে অনেকের ধারণা।
সংসদে রাহুলের ইতিমধ্যেই এক তরুণ, তুর্কি গোষ্ঠী আছে। তারা চাইছেন রাহুল এখনই প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের ভার নিন। কারণ পরপর অনেকগুলো স্ক্যামে ভারাক্রান্ত হয়ে ইউপিএ সরকারের ভাবমূর্তি বেশ কিছুটা ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। এই সময় নতুন নেতৃত্ব এনে কংগ্রেস আবার পুনর্জীবন পাবে।
ব্যক্তিগতভাবে ড. মনমোহন সিংয়ের নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি আজও কিন্তু অম্লান। নেহরুর পর অমন বিদগ্ধ প্রধানমন্ত্রী ভারত আর পায়নি। ব্যক্তিগত জীবনে অমায়িক ভদ্র এবং একটাও আজেবাজে কথা বলে কখনও বিতর্কের সৃষ্টি করেননি তিনি। ইন্দিরা গান্ধীকে যেমন প্রথমদিকে সিন্ডিকেটের নির্দেশে চলতে হতো, মনমোহনকেও তেমনি কয়েকজন প্রবীণ নেতার ওপর পদে পদে নির্ভর করে চলতে হয়। যেমন_ প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদাম্বরম, কেপি সিব্বাল। তাদের মধ্যে সিব্বাল সাহেব আবার হামবড়া ভাব ও অবিনয়ের জন্য বিখ্যাত। রাহুল ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেড়ে উঠলেও তিনি কিন্তু একদিনের জন্যও মনমোহনের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। তাকে গলা চড়িয়ে অন্য মন্ত্রীদের ধমকাতেও কেউ শোনেনি। তার মধ্যে ছাত্রসুলভ একটা ভাব রয়েছে। এই যে তিনি ক'দিন আগে উত্তর প্রদেশে গিয়ে জমিহারা কৃষকদের পাশে দাঁড়ালেন, সেখানেও মায়াবতী সরকারের বিরুদ্ধে এমন কোনো বিতর্কিত কথা তিনি বলেননি, যাতে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এমনকি তার জন্মদিন নিয়ে কোনো বাড়াবাড়িও তিনি পছন্দ করেননি। কোনো অনুষ্ঠানও করতে দেননি। জন্মদিনে সারাদিন কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ৪১ বছরের ওই সুযোগ্য ব্যাচেলর।
যতদূর খবর, সোনিয়া গান্ধী চান অন্তত আরও এক বছর ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকুন। এক বছর পরে ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। মনমোহন সেখানেও প্রার্থী হতে পারেন। তখন ওই শূন্যপদে রাহুলের প্রবেশ শোভন হবে। আর নির্বাচনের মুখে তরুণ নেতৃত্ব কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
এই মুহূর্তে দিলি্লর ইউপিএ সরকারের সামনে কোনো বড় রকমের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কেরলে ও পশ্চিমবঙ্গে ভরাডুবির পর বামেরা একেবারে কোণঠাসা। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিএম মাত্র ৪০টি আসন পায়। এর মধ্যে একজন আত্মহত্যা করায় তাদের সদস্যসংখ্যা এখন ৩৯। যিনি বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন সিপিএমের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র ভালো বক্তা নন। মুখ্য সচেতক (চিফ হুইপ) আবদুল রেজ্জাক মোল্লা সাবেক ভূমি রাজস্বমন্ত্রী আবার মমতার প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করেন। বামফ্রন্টের মধ্যে প্রধান দল আরএসপির সাবেক পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর পত্নীকে মমতা সরকারি নারী কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান করেছেন। এতে ক্ষিতিবাবুও মমতার প্রতি নরম। মমতা এখন সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দূত পাঠাচ্ছেন তাকে টানার জন্য। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জাত কমিউনিস্ট। তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দিলেও তিনি মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট বলেই নিজেকে ঘোষণা করেছেন। গত নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীর হয়েই প্রচার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল থেকে সিপিএমকে উৎখাত করাটাকে কংগ্রেস নেতারা বড় জয় বলে মনে করছেন। যদিও তামিলনাড়ূতে দুর্নীতিগ্রস্ত ডিএমকের সঙ্গে গাঁটছড়া অটুট রাখতে গিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-ডিএমকে জোটের ভরাডুবি হয়েছে। ডিএমকে ইউপিএ সরকারের এখনও শরিক। কিন্তু ডিএমকে ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে এআইডিএমকের জয়ললিতা (যিনি এখন তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী) তিনি ইউপিএকে সমর্থন দেবেন জানিয়েছেন। তেমনি উত্তর প্রদেশ থেকে মুলায়ম সিং যাদবের দল তো ইউপিএকে বাইরে থেকে সমর্থন করে আসছেই। বিজেপির মধ্যেও এখন অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট। কাজেই ইউপিএ সরকার অল্প মেজরিটিতেও আগামী দু'বছর দিব্যি চালিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু সমস্যাটা আসছে অন্য জায়গা থেকে। এই সর্বপ্রথম ভারতের সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে আন্না হাজারে নামে ৭৫ বছরের এক গান্ধীবাদী নেতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের যেখানে কালঘাম ছুটে যায় আর বিনা প্রস্তুতিতে আন্না হাজারে গত মে মাসে যখন দিলি্লর যন্তরমন্তরে অনশন করলেন তখন কোন মন্ত্রবলে ভারতের ঝকঝকে তরুণ প্রজন্ম দলে দলে এসে তার আন্দোলনে শামিল হলো। তার আন্দোলনের কথা পাঠক ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। তিনি অনশন করছিলেন ভারতের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ঠেকাতে। দুর্নীতিগ্রস্তরা প্রায়ই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ছাড়া পেয়ে যায়_ এ কারণে ভারতীয় সংবিধানের মধ্যেই নিরপেক্ষ লোকপাল ও রাজ্যের জন্য লোকায়ুধ নিয়োগের প্রস্তাব ছিল। লোকায়ুধ কয়েকটি রাজ্যে আছে। লোকপালের ক্ষমতা কী হবে তা নিয়ে এতদিন বিতর্ক ছিল, ফলে ওই বিলটি আর গৃহীত হয়নি। আন্না চেয়েছিলেন নতুন করে লোকপাল বিলের খসড়া করতে হবে এবং খসড়া কমিটিতে নাগরিক সমিতির প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
আন্নার দাবি মেনে সরকার একটি খসড়া কমিটি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু এই খসড়া নিয়ে সরকারপক্ষের সঙ্গে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আন্না চান প্রধানমন্ত্রীকে এই বিলের আওতায় আনা হোক। সরকার চাইছে, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লোকপাল যদি তাকে দুর্নীতির অভিযোগে টানাহেঁচড়া করে (করতেই পারে। কারণ লোকপাল সরকারের নিযুক্ত কেউ হবেন না। একটি স্বাধীন কমিটি তাকে নির্বাচিত করবে) তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই লোকপাল তদন্ত করতে পারেন।
কিন্তু আন্না হাজারে অনমনীয়। তিনি বলেছেন, কোনো কারণে লোকপাল বিল গৃহীত না হলে ১৬ আগস্ট থেকে তিনি আমরণ অনশন করবেন। এই চরমপত্র পেয়ে কংগ্রেস নেতাদের অস্বস্তি ও তৎপরতা দুটিই বেড়েছে। ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাচ্ছিলেন সোনিয়া। তিনি তড়িঘড়ি ছুটি বাতিল করে দিলি্ল চলে এসেছেন আর প্রণব মুখোপাধ্যায় বিদেশ যাত্রা বাতিল করেছেন। প্রথমদিকে আন্না হাজারের প্রতি নরম ছিলেন সোনিয়া। কিন্তু এখন ক্রমশ তিনি কঠোর হচ্ছেন। আন্নাকে মাঝামাঝি রফা করতে বলছেন। চাইছেন প্রধানমন্ত্রীকে লোকপালের আওতা থেকে বাদ দিতে। আন্না এখনও অনমনীয়।
প্রশ্ন উঠেছে, আন্না যদি অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া কী হবে? কংগ্রেসের ভেতরে একদল বলছে, কিস্যু হবে না। দু'দিনেই সব বিক্ষোভ থামিয়ে দেওয়া যাবে। বরং আন্নাকে এতদূর বাড়তে দেওয়া উচিত হয়নি। নাগরিক সমাজ কোনো দেশের আইন তৈরি করে নাকি? নির্বাচিত সংসদ রয়েছে কী করতে? এই প্রথম অনির্বাচিত সদস্যদের একটা গুরুত্বপূর্ণ আইনের খসড়া করতে দেওয়া হলো। এই খসড়া তো সংসদে যাবে। সেখানে সংখ্যাগুরু সদস্যরা তো বিলের যে কোনো ধারা বাতিল করে দিতে পারেন। অনেক সংবাদপত্র সংবিধানবহির্ভূত শক্তিকে (পড়ূন নাগরিক সমাজ) এত বাড়তে না দিতে সরকারকে অনুরোধ করেছে। কংগ্রেসের মধ্যেও এ নিয়ে ঘোরতর বিতর্ক আছে। ইতিমধ্যে আন্নার দেখাদেখি বিশ্ববিখ্যাত যোগগুরু রামদেব (বাংলাদেশেও তার আস্থা-চ্যানেল জনপ্রিয়) কালো টাকা উদ্ধারের দাবিতে দিলি্লর রামলীলা ময়দানে ৫০ হাজার ভক্তকে নিয়ে অনশনে বসেছিলেন। প্রথম দিনে ইউপিএ সরকারের চার সিনিয়র মন্ত্রী তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। রামদেব শোনেননি। দু'দিনের মাথায় মধ্যরাতে অনশনকারীরা যখন ঘুমাচ্ছিল তখন কয়েক হাজার পুলিশ লাঠিপেটা করে ভক্তদের হটিয়ে দেয়। পুলিশ বাবা রামদেবকে ধরে প্লেনে চাপিয়ে হরিদ্বারে নিয়ে ছেড়ে দেয়। সেখানেও রামদেব আরও ক'দিন অনশন চালিয়ে পরে নিঃশর্তভাবে অনশন ভঙ্গ করেন। রামদেবের এই পশ্চাদপসরণে কংগ্রেসীরা খুশি। কিন্তু অনেকে বলছেন, বাবার এক কোটি ভক্তের কাছে এটা নিয়ে একটা ভুল বার্তা পেঁৗছতে পারে। তা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে নাগরিকরা যখন বিক্ষোভ জানাচ্ছিলেন তখন তাদের ওপর অতর্কিত এই পুলিশি হামলা গণতন্ত্রের পক্ষে অশুভ সূচনা। রামদেবকে না হয় মেরে হটিয়ে দেওয়া হলো। রাজনৈতিক দল গড়ার অভিসন্ধি নিয়ে রামদেবের এই অনশন। তার পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে বিজেপি আছে। এসব কারণে এই লাঠি চালনা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। কিন্তু আন্না হাজারের পটভূমি তো একটু স্বতন্ত্র। আন্না হাজারে একজন মারাঠি গান্ধীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট। ছোটবেলায় চরম দারিদ্র্যের জন্য মুম্বাই শহরে ক্লাস এইট পর্যন্ত ফুল বিক্রি করতেন। এরপর সেনা বিভাগে ড্রাইভার পদে যোগ দেন। ১২ বছর পরে আর্মি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে গ্রামে ফিরে চাষিদের মধ্যে গঠনমূলক কাজ শুরু করেন। তার কাজের জন্য কৃষকদের ফলন বাড়ে। ১৯৯০ সালে সরকার তাকে পদ্মভূষণ ও ১৯৯২ সালে পদ্মবিভূষণ দেয়। মহারাষ্ট্রে তার অনশন আন্দোলন সফল হয়। এখন দিলি্লতে তার এই আন্দোলনের দিকে সারাদেশ তাকিয়ে আছে।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.