কালের পুরাণ-ইতিহাসের কাঠগড়ায় জিয়া-এরশাদ by সোহরাব হাসান

উচ্চ আদালতে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, ক্ষমতা জবরদখলকারীদের বিচার হবে কি না? আদালতের রায়ে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। আদালত বলেছেন, ভবিষ্যতে অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে জাতীয় সংসদ শাস্তি নির্ধারণ করে আইন পাস করতে পারে।


তবে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচারের জন্য নতুন আইন করার প্রয়োজন নেই। দণ্ডবিধি অনুযায়ীই তাঁদের বিচার করা সম্ভব। আইনের আদালতে স্বৈরশাসকদের বিচার না হলেও জনতার আদালতে অনেক আগেই বিচার হয়ে গেছে। এখন তাঁরা ইতিহাসের কাঠগড়ায়।
জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদ—কেউই গণতান্ত্রিক শাসক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে পারেননি। গণতন্ত্রের জন্য প্রচুর মায়াকান্না করেও দেশবাসী কিংবা বহির্বিশ্বে তাঁরা চিহ্নিত হয়ে আছেন স্বৈরশাসক হিসেবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁদের ভূমিকা নেই। ভূমিকা আছে মানুষের অধিকার হরণে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫—৯০ পর্বটি সামরিক শাসনের কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো কোনো পণ্ডিত দুরবিন দিয়ে জিয়াউর রহমানের মধ্যে গণতন্ত্রের উপাদান খোঁজার চেষ্টা চালালেও সেনাশাসকই তাঁর প্রথম ও শেষ পরিচয়। এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে পার্থক্য খুব কম। তাঁরা দুজনই দেশ ও গণতন্ত্র উদ্ধারের কথা বলে ক্ষমতা দখল করেছেন। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার ওয়াদা করেছেন। কিন্তু ব্যারাকে ফিরে যাননি। তাঁরা তখনই নির্বাচন দিয়েছেন, যখন নিজের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরা গণভোটের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন। দুই সামরিক শাসকই স্থানীয় সরকার সংস্থার একমাত্র কার্যকর প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সমর্থন আদায় করেছেন। দুজনই সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করেছেন কমবেশি চার বছর। জিয়ার সামরিক শাসন বহাল ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর থেকে ঊনআশি সালের এপ্রিল তক। এরশাদ বিরাশির ২৪ মার্চ থেকে ছিয়াশির ১০ নভেম্বর। সেনাপ্রধানের পদে বহাল থেকে তাঁরা দুজনই রাজনীতি করেছেন, রাজনৈতিক দল ভাঙাগড়ায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেছেন। দুর্নীতির দায়ে যাঁদের জেলে ঢুকিয়েছেন, তাঁদের মন্ত্রীও করেছেন।
তাঁদের ক্ষমতায় আরোহণ, শাসনপদ্ধতি, সামরিক আদালতে বিচার-প্রক্রিয়া, গণভোট, দল গঠনের কৌশলে কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেন, দালাল আইন বাতিল করে জেল থেকে কুখ্যাত দালালদের বের করে আনেন। আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার নামে তিনিই দেশে রাজাকারতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। জিয়া আওয়ামী বাকশালকে গালাগালের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাহ আজিজের মতো একজন চিহ্নিত রাজাকারকে বসিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদে। হাইকোর্টের রায়ে তাঁর এসব অপকর্মের কিছু বিবরণও আছে। ব্যক্তিগতভাবে জিয়া সৎ থাকলেও রাজনীতিকে মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছেন।
এরশাদ ভিন্ন নামে হলেও জিয়ার রাজনীতিকেই অনুসরণ করেন। জিয়া মাওলানা মান্নানকে দলে নিলেও মন্ত্রী বানাননি। এরশাদ তাঁকে পূর্ণ মন্ত্রী বানান। তিনিও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে পুরোনো মুসলিম লীগের রাজনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটান। জিয়ার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল আওয়ামী লীগ; এরশাদ বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপিকে ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে মহাদুর্ভিক্ষ চলছে, তার সূচনাও ঘটে সামরিক শাসনামলে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যে সরকারটি আমরা পেয়েছিলাম, তাদের অনেক দুর্বলতা ছিল। জাতীয় ঐক্যের সুবর্ণ সুযোগটি তাঁরাই হারিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করা কিংবা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের যে অভিযোগ, তাও অসত্য নয়। এসব পুঁজি করে দুই সামরিক শাসকই বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির মৌল নীতি ও আদর্শ সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন। রাজনৈতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের বদলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপরাজনীতি চালু করলেন। তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে এলেন অনেক বাঘা বাম রাজনীতিক। আজ যাঁরা মহাজোটের শরিক হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ‘একটা-দুইটা বাকশাল ধরো, সকাল-বিকাল নাশতা করো’জাতীয় স্লোগান দিতেও দ্বিধা করেননি। রাজনীতি যখন সীমা লঙ্ঘন করে, তার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, বাংলাদেশ বহুবার তা প্রত্যক্ষ করেছে। অতএব, দেশের দুরবস্থার দায় কেউ এড়াতে পারেন না।
জিয়া ও এরশাদ—এই দুজনের মধ্যে কে বেশি খারাপ বা কম খারাপ, সেই বিতর্ক অর্থহীন। তাঁরা দুজনই দেশ ও জনগণের মহাসর্বনাশ করেছেন। সেই সর্বনাশ থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। আদালত বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র। আসল কাজটি করতে হবে রাজনীতিকদেরই; যাঁরা দেশ চালাবেন।
আওয়ামী লীগের দোষ ছিল বিরোধিতা সহ্য করতে না পারা, ১৯৭৩-৭৪ সালে এসেও তারা সত্তরের নির্বাচনী বিজয়োল্লাসে মেতেছিল। গণতন্ত্র মানে যে বিরোধী দলের সক্রিয় উপস্থিতি এবং বহু মতের সহাবস্থান—এ কথাটি আমাদের রাজনীতিকদের অভিধানে নেই। তাঁরা মনে করেন, হয় অনুরাগী হও অথবা অনুগত থাকতে বাধ্য করো। এটি ছিল প্রকাশ্য মাস্তানি। কিন্তু সামরিক শাসকেরা যে কাজটি করেছেন তা হলো, সমাজ ও রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির থাবা বিস্তার। অর্থ দিয়ে, পদ দিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে তাঁরা একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেন। সকালে সরকারবিরোধী জোটের বৈঠক করে রাতে সেই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দৃষ্টান্তও দুর্লভ নয়।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জবাবদিহি থাকে। রাজনীতিকদের জনগণের কাছে যেতে হয়। কিন্তু সামরিক শাসনে সেই সুযোগ নেই। তাঁরা জনগণের ভেতরে গিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়ে দল করেন না। দল করেন বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে।
প্রশ্ন হলো, আমরা জিয়া ও এরশাদের সেই সামরিক মনস্তত্ত্ব থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আদালত যেসব অভিযোগে জিয়াউর রহমানের অন্যায়কে গুরুতর বলেছেন, সেসবের অবসান ঘটাতে চাই কি না। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানে রাষ্ট্রের চার মৌলিক নীতিকে বদলে দিয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলেছিলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেগুলো সম্পর্কে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরকারের মধ্যে যখন দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়, যখন এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম রাখা না-রাখার দ্বন্দ্বে ভোগে, তখন মনে হয় আসলে তারা পঁচাত্তরের বদলকেই মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হন্তারকদের বিচার করলেও তাঁর আদর্শ পুনঃস্থাপিত করতে পারেনি। সম্ভবত করতে চায়ও না।
গণতন্ত্র ও সামরিক আইনের আরেকটি মৌলিক পার্থক্য হলো, প্রথমটির নিয়ন্তা জনগণ। ভোটের মাধ্যমে তারা কোনো দলকে গ্রহণ করে, কোনো দলকে নাকচ করে দেয়। কিন্তু সামরিক শাসনে সেই সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীনেরা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে এমনভাবে সাজিয়ে গণভোট বা নির্বাচনের আয়োজন করেন, যাতে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট না দিতে পারেন। প্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশনকে তাঁরা আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন, যাদের কাজ হয় ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট রাখা। দুই সামরিক শাসকই এই মহড়া দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল—একটি জনগণের মধ্য থেকে আসা, অপরটির জন্ম সেনানিবাসে। ফলে তার গঠনপদ্ধতি, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রেও স্পষ্ট পার্থক্য ছিল। গত দেড় দশকে সেই পার্থক্যটি প্রায় ঘুচে গেছে। এটি ভালো লক্ষণ নয়।
আদালত অতীতের ভুল সংশোধনে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এত দিন যাঁরা উর্দির ওপর তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাসটি পরেছিলেন, আদালত সেই পোশাকটি খুলে ফেলেছেন। এখন সামরিক শাসকদ্বয়ের অবস্থা হয়েছে গল্পের সেই ন্যাংটো রাজার মতো।
অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু অতীতকে বদলাতে পারব না। আমাদের তাকাতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত আছে কি না? বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলটি। সরকার ও বিরোধী দলের টানাপোড়েন কোথায় গিয়ে ঠেকবে? কেবল আদালত নন, সরকারও অতীত সংশোধন করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০০১ সালের পর দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কারা লাগিয়েছে, কারা সংখ্যালঘুবিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতাদের খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই ভালো পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি যখন দেখি আরেক বোমা হামলার (মালিবাগ) আসামিদের নাম বিচারের আগেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে, তখন খটকা লাগে। মেলাতে পারি না।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনীতিটা কী হবে, সেটি আদালত নির্ধারণ করবেন না, নির্ধারণ করবেন রাজনীতিকেরাই। ১/১১-এর আগে দেশে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, সেটি গণতন্ত্রের সহায়ক নয়। সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এ নিশ্চয়তা কি রাজনীতিকেরা দিতে পারবেন?
বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরাসরি পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর সঙ্গে যুক্ত। দুই দলের প্রতিষ্ঠাতাই দেশে সামরিক শাসন জারি করেছেন বা উত্তরাধিকার সূত্রে পেলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। এখন বিএনপি বা জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে? তারা কি গণতন্ত্রের পথে চলবে, না সামরিক শাসকের লিগাসি বহন করে যাবে? তারা যদি সত্যি সত্যি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে উচিত হবে অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। আর যদি তারা অতীতের বৃত্তে নিজেদের আবদ্ধ রাখে, তাহলে কখনোই গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগকেও বিষয়টি দেখতে হবে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আলোকে। কেবল অতীতের গৌরবে গর্বিত হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আদালত যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, সেই গণতন্ত্রে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সব দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার।
সম্প্রতি একটি পত্রিকার (জনকণ্ঠ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু সীমারেখা লঙ্ঘন করতে পারে না। যেসব দেশে গণতন্ত্র সচল আছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নাক গলায় না। ‘অচল’ গণতন্ত্রের দেশে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে। পাকিস্তান যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখন আওয়ামী লীগকেই ঠিক করতে হবে, তারা গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, না পরিত্যক্ত সামরিক শাসকদের দেখানো পথে? গণতন্ত্র হলো সুশাসন, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি এ ব্যাপারে প্রস্তুত আছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.