লেখালেখি নিয়ে অরহান পামুক-ভূমিকা ও অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী

বয়স বায়ান্নতে পৌঁছার আগেই পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার লাভ, অন্তত ত্রিশটি প্রধান ভাষায় নিজের উপন্যাস অনূদিত হতে দেখা এবং চুয়ান্নতে পৌঁছেই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ গত অর্ধশতকে তুর্কি ঔপন্যাসিক অরহান পামুক ছাড়া আর কোনো সাহিত্যিকের বেলায় ঘটেনি।


৭ জুন ১৯৫২, তাঁর জন্ম তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। এবার তাঁর ৬০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে।
অরহান পামুক ২০০৬ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান। এর আগের কয়েকটি বছর তিনি পুরস্কারের জন্য এমনই ‘হট ফেভারিট’ ছিলেন যে ২০০৫ সালে যখন সুইডিশ একাডেমি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ দেওয়ার জন্য নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারকে ফোন করেন, তিনি বললেন, ‘আমি ভেবেছি, অরহানের খবরটা দেওয়ার জন্য আমাকে ফোন করেছে।’ অরহান পামুক অবিরাম লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন লিখছেন?
‘আমি লিখি। কারণ, লেখার জন্য আমার অন্তর্গত তাড়না রয়েছে। আমি লিখি। কারণ, আমি আপনাদের সবার ওপর, প্রত্যেকের ওপর ক্ষুব্ধ। আমি লিখি। কারণ, আমি কাগজ-কলম ও কালির গন্ধ ভালোবাসি, কারণ আমি সাহিত্যে বিশ্বাস করি। উপন্যাসের কলাকৌশলে আমি বেশি বিশ্বাস করি।’
একই সঙ্গে বেস্ট সেলিং লেখকদের একজন হওয়া এবং একে একে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কারগুলো পাওয়া আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে একটি দুর্লভ ঘটনা।
২০০৬ সালে অরহান পামুক লিখলেন, ‘আমি তিরিশ বছর ধরে লিখছি...আমি আরও তিরিশ বছর ধরে লিখতে চাই।’
একটি পাদটীকা: ৫৯ বছর বয়সে অরহান পামুক ঔপন্যাসিক কিরণ দেশাইর প্রেমে পড়েছেন। প্রেমের কথা কিরণ দেশাই গণমাধ্যমে স্বীকারও করেছেন।
অরহান পামুক লেখালেখি নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। একটি সাক্ষাৎকার ও দুটি গদ্য রচনা থেকে আংশিক অনুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে ৬০তম জয়ন্তীতে পূর্ব ও পশ্চিমের সেতুবন্ধ রচনাকারী এই কথাশিল্পীকে অভিনন্দন।

চিত্রশিল্পী নয়, লেখকই হবেন
সাত বছর বয়স থেকেই তাঁর চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে, পরিবারেরও তাতে আপত্তি নেই। সবাই ভেবে নিয়েছেন তাঁদের ছেলেটি বিখ্যাত শিল্পী হবে। কিন্তু তাঁর বয়স যখন ২২ বছর তখন এমন একটা কিছু ঘটল যে তিনি টের পেলেন মাথার একটা স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। আর তখনই আঁকাআঁকি বন্ধ করে দিয়ে তিনি প্রথম উপন্যাসে হাত দিলেন। অরহান পামুক এভাবেই বর্ণনা করছিলেন তাঁর লেখক হয়ে ওঠার কাহিনি প্যারিস রিভিউর পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী অ্যাঞ্জেল গুরিয়া কুইনটানাকে, ২০০৪-এর মে এবং ২০০৫-এর এপ্রিলে দুপর্বে ধারণ করা একটি সাক্ষাৎকারে। এই সাক্ষাৎকার থেকে তাঁর লেখক হওয়ার কাহিনির নির্বাচিত অংশ অনূদিত হলো:
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেল?
পামুক: এমনটা করার (আঁকা ছেড়ে লেখা) কারণ কী আমি বলতে পারব না। হালে প্রকাশিত হয়েছে আমার বই ইস্তাম্বুল। সেই মুহূর্ত পর্যন্ত এই বইয়ের অর্ধেকটা আমার আত্মজীবনী, আর অর্ধেক ইস্তাম্বুল নিয়ে একটি রচনা, আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে বাকিটা একটি শিশুর চোখে ইস্তাম্বুল। নগরের চিত্রকল্প, ভূ-প্রকৃতি ও রসায়ন আর সে শহর সম্পর্কে শিশুটির ধারণা ও শিশুটির আত্মজীবনী নিয়ে ভাবনার মিশ্রণ ঘটেছে এই বইটিতে। ইস্তাম্বুল গ্রন্থের শেষ লাইনে লেখা হয়েছে, ‘আমি চিত্রশিল্পী হতে চাই না’, ‘আমি একজন লেখক হতে যাচ্ছি।’ এর ব্যাখ্যা করা হয়নি, যদিও পুরো বইটা কিছু একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনার এ সিদ্ধান্তে পরিবার কি খুশি হয়েছে?
পামুক: আমার মা মুষড়ে পড়েছেন। আমার বাবা কিছুটা সহমর্মী ছিলেন, কারণ তাঁর যৌবনেও তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, তুর্কি ভাষায় পল ভ্যালেরি অনুবাদ করেছেন তিনি। কিন্তু সমাজের যে উঁচু বৃত্তের অংশ ছিলেন তিনি, তাঁদেরই উপহাসে একসময় লেখালেখি ছেড়ে দেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: পরিবার আপনার চিত্রশিল্পী হওয়াটা মেনে নিল, কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটা মানতে পারল না?
পামুক: হ্যাঁ, কারণ তারা মনে করেনি আমি একজন সার্বক্ষণিক চিত্রশিল্পী হব। আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য পূর্ত প্রকৌশলীর। আমার দাদা পূর্ত প্রকৌশলী ছিলেন, রেলপথ নির্মাণের ঠিকা নিয়ে অনেক টাকা বানিয়েছেন। আমার বাবা ও চাচারা টাকা খুইয়েছেন, কিন্তু তাঁরা সবাই একই প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান। এটাই প্রত্যাশিত ছিল যে আমিও সেখানেই পড়তে যাব। কিন্তু আমি যেহেতু পরিবারের একজন শিল্পী, সবার ধারণা আমি একজন স্থপতি হব। আর সবার কাছে এটাই ছিল একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান। অতএব আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, কিন্তু স্থাপত্যবিদ্যা শিক্ষার মাঝামাঝি সময়ে আমি হঠাৎ ছবি আঁকা ছেড়ে দিলাম আর উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: যখন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন কি আপনার প্রথম উপন্যাসটি মাথায় এসে গেছে? আর সে কারণেই কি ছেড়ে দিলেন?
পামুক: আমার যত দূর মনে পড়ে, কী লিখব তা বোঝার আগেই আমি ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছি। সত্যি বলতে কি যখন লিখতে শুরু করি দুটো বা তিনটে প্রচেষ্টা ব্যর্থই হয়। সেই নোটবইগুলো এখনো আমার কাছে আছে। প্রায় ছয় মাস পরে আমি একটি বড় উপন্যাস প্রকল্প হাতে নিই এবং শেষ পর্যন্ত সেভদেত বে অ্যান্ড হিজ সন্স প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: এটি তো ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি?
পামুক: এটা আসলে একটি পারিবারিক উপাখ্যান, টোমাস মানের বাডেনব্রুকস-এর মতো। এই উপন্যাসটি শেষ করার পর বেশি দিন যায়নি, আমি অনুতাপ করতে শুরু করি, আমি এমন একটি পুরোনো ধাঁচের ঊনবিংশ শতকীয় উপন্যাস লিখলাম! আমি অনুতপ্ত হলাম এ জন্যই যে আমার বয়স যখন ২৫-২৬, আমি নিজের ওপর একটি ধারণা আরোপ করতে সমর্থ হলাম যে আমাকে একজন আধুনিক লেখক হতে হবে। আমার বয়স যখন ৩০, শেষ পর্যন্ত আমার উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হলো, আমার লেখা তত দিনে অনেক বেশি পরীক্ষামূলক হয়ে উঠেছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনি যখন বলেন, আপনি আধুনিক ও নিরীক্ষাধর্মী, তখন কি আপনার মনে কোনো মডেলের উপস্থিতি ছিল?
পামুক: তত দিনে তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, স্তাঁদাল কিংবা টোমাস মান আমার জন্য আর মহান লেখক নন। তখন আমার আরাধ্য ভার্জিনিয়া ওলফ এবং ফকনার। এখন সে তালিকার সঙ্গে যোগ করব মার্সেল প্রুস্ত ও ভ্লাদিমির নবোকভের নাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনার দ্য নিউ লাইফ-এর প্রথম লাইনটি হচ্ছে ‘আমি একদিন একটি বই পড়লাম এবং আমার গোটা জীবন বদলে গেল।’ আপনার নিজের ওপর কোনো বইয়ের এ ধরনের প্রভাব রয়েছে কি?
পামুক: আমার বেলায় (উইলিয়াম ফকনারের) দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি খুব গুরুত্বপূর্ণ—তখন আমার বয়স ২১ কিংবা ২২ বছর। আমি পেঙ্গুইন প্রকাশনার একটি কপি কিনলাম। আমার দুর্বল ইংরেজি জ্ঞানে এটা বোঝা কষ্টকর। কিন্তু তুর্কি ভাষায় আমি একটি চমৎকার অনুবাদ পেয়ে গেলাম। কাজেই দুটোই টেবিলে রেখে একবার এটার এক প্যারাগ্রাফ, একবার ওটার এক প্যারাগ্রাফ পড়তে শুরু করি। বইটি আমার ওপর ছাপ রেখে গেছে। এর তলানিতেই গড়ে ওঠে আমার স্বর। আমি শিগগিরই উত্তম পুরুষে লিখতে শুরু করলাম। অধিকাংশ সময়ই তৃতীয় পুরুষে লেখার চেয়ে অন্য কারও হয়ে প্রথম পুরুষে লিখতে আমার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনি বলেছেন, আপনার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হতে বছরের পর বছর লেগে গেছে?
পামুক: সাহিত্যিক মহলে আমার কোনো বন্ধু ছিল না। আমি ইস্তাম্বুলের কোনো সাহিত্যগোষ্ঠীিতেই ছিলাম না। আমার প্রথম বই প্রকাশের একটি মাত্র উপায়ই ছিল, অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। আমি তা-ই করলাম, পুরস্কারও পেলাম, একজন বড়, ভালো প্রকাশক আমার বইটি ছাপবে বলে ঠিক হলো। সে সময় তুরস্কের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। তারা ‘আপনার সঙ্গে চুক্তি করব’ বললেও নানা বললেও নানা কারণে উপন্যাসের প্রকাশনা বেশ পিছিয়ে গেল।

প্রতিদিন এক ডোজ সাহিত্য
লেখক হিসেবে আমি আমার ৩১তম বছরে প্রবেশ করছি। এখনো আমার বলতে ইচ্ছে করে, আমি ৩০ বছর ধরে উপন্যাস লিখছি—এর মধ্যে কিছুটা অতিশয়োক্তি রয়েছে। বিভিন্ন সময় আমি অন্য ধরনের লেখাও লিখেছি: প্রবন্ধ, সমালোচনা, ইস্তাম্বুল স্মৃতি, কিংবা রাজনীতি এবং ভাষণ। কিন্তু আমার সত্যিকার পেশা, যা আমাকে জীবনের সঙ্গে আবদ্ধ করে রেখেছে, তা হচ্ছে উপন্যাস রচনা। বহুসংখ্যক মেধাবী লেখক রয়েছেন, যাঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে লিখছেন, যাঁরা এর প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়েই অর্ধশতাব্দী ধরে লিখে যাচ্ছেন। অনেক মহান লেখক রয়েছেন, আমি যাঁদের কাছে বারবার ফিরে যাই—তলস্তয়, দস্তোয়ভস্কি এবং টোমাস মান, যাঁদের লেখালেখির জীবন ৫০ বছরেও বেশি...তাহলে আমি আমার লেখক-জীবনের ৩০ বছর নিয়ে এত মতামাতি করছি কেন? আমি করছি, কারণ লেখালেখি সম্পর্কে আমি বলতে চাই, বিশেষ করে অভ্যাসবশত উপন্যাস লেখা নিয়ে।
আমাকে সুখী হওয়ার জন্য নিত্যকার সাহিত্যের ডোজ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। যে রোগীকে প্রতিদিন এক চামচ ওষুধ খেতেই হবে, এ দিক দিয়ে আমি তার চেয়ে ভিন্ন কেউ নই। ছোটবেলায় আমি যখন শুনলাম, ডায়াবেটিস রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিন একটি করে ইনজেকশন নিতে হয়, আর সবার মতো আমিও তাদের জন্য খারাপ বোধ করলাম। এমনকি তখন আমার মনে হয়েছে, তারা অর্ধমৃত। এমনভাবে সাহিত্যের ওপর আমার এ নির্ভরতা আমাকেও অর্ধমৃত করে রেখেছে। বিশেষ করে যখন আমি তরুণ লেখক, অন্যরা আমাকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন বিবেচনা করছে বলে আমি আঁচ করি—সুতরাং আমার ‘অর্ধমৃত্যু’ তো অনিবার্য—কিংবা এর সঠিক শব্দচয়ন হতে পারে ‘অর্ধপ্রেতাত্মা’। কখনো কখনো আমি এই ধারণাটিও লালন করেছি যে আমি পুরোপুরিই মৃত এবং সাহিত্যের সাহায্যে আমার মৃতদেহে জীবন ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। আমার বেলায় সাহিত্য হচ্ছে ওষুধ। অন্যরা যেমন চামচ দিয়ে কিংবা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ গ্রহণ করে, আমার দৈনিক সাহিত্য ডোজ, আমার নিত্যকার নির্ধারিত পরিমাপ—তার অবশ্যই প্রমিত মান রক্ষা করতে হবে।

আমার সবচেয়ে বড় আশা, আমি আরও ৩০ বছর উপন্যাস লিখে যেতে পারব...।
[আদার কালার্স গ্রন্থ থেকে নেওয়া]

পামুকের প্রতিশোধ
আমি যখন ছোট বালক ছিলাম, আমার বয়সী একটি বালক, নাম হাসান, তার গুলতির ছোড়া পাথর দিয়ে আমার চোখের ঠিক নিচে আঘাত করে। অনেক বছর পর অন্য এক হাসান আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার উপন্যাসের সব হাসান এত শয়তান কেন? তখন আমার এই স্মৃতিই ফিরে আসে। মাধ্যমিক স্কুলে মোটাসোটা একজন উত্ত্যক্তকারী ছিল, যার কাজই ছিল একটা উপলক্ষ বের করে টিফিনের সময় আমার ওপর নির্যাতন চালানো। অনেক বছর পর তাকে একটি অনাকর্ষণীয় চরিত্র বানানোর জন্য তার মতো মটকুর গা দিয়ে প্রচুর ঘাম ঝরাই। সে এতই মোটা যে চলতে-ফিরতে পারত না, দাঁড়িয়ে থাকতে হতো আর তার সমস্ত শরীর, হাত, কপাল দিয়ে ঘামের বিন্দু এসে জমা হতো। তাকে দেখাত অতিকায় কলসির মতো, যেন এই মাত্র রেফ্রিজারেটর থেকে বের করা হয়েছে।
[আদার কালার্স গ্রন্থের ‘এ নোট অন পোয়েটিক জাস্টিস’ থেকে নেওয়া।]

No comments

Powered by Blogger.