২৫ মার্চ '৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ও গণহত্যার পটভূমি by ডা. এম এ হাসান

১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং '৭০-এর নির্বাচনের পর এ দেশে জনগণের ওপর পাকিস্তানিদের আঘাত যে অবশ্যম্ভাবী ছিল, তা এ দেশের সচেতন নাগরিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতারা অনুধাবন করেছিলেন। এ আক্রমণ প্রতিরোধে সুস্পষ্ট প্রস্তুতি না থাকলেও নানামুখী নীরব প্রতিরোধ অব্যাহত ছিল।


এর কিছু ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে। এই প্রতিরোধ ও প্রস্তুতিমূলক আক্রমণের সমন্বিত প্রকাশ ছিল আলোচনার মধ্য দিয়ে সংঘাত পরিহার, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের অসামান্য ভাষণ এবং অতঃপর সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধ প্রতিরোধ এবং বন্ধু খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চলে। এসব চলে এমন নিপুণ হাতে, যার নজির সমগ্র বিশ্বে পাওয়া কঠিন। তার পরও পাকিস্তান সামরিক আঘাতের জন্য গোপন প্রস্তুতি নেয় এবং বাঙালি সেনাদের আঘাতের জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি পিআইএযোগে (পাকিস্তানি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস) ২২ বেলুচ ও ১৩ ফ্রনটিয়ার ফোর্সকে গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠাতে শুরু করে। এদিকে এই গোপনীয়তা বজায় রাখতে এবং তথাকথিত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে জেনারেল ইয়াকুব BLTTZ নামের একটি সামরিক পরিকল্পনা নেয় ফেব্রুয়ারির শেষে।
জেনারেল ইয়াকুব সংঘাত এড়াতে চাইলেও জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, মেজর জেনারেল এ ও মিট্ঠা খান, মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ও মেজর জেনারেল টিক্কা খানকে পথ করে দিতে বাধ্য হলেন। এসব আগ্রাসী তথা নষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন জেনারেলদের ভুট্টো সমর্থক যেসব অফিসার উস্কানি দিচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, কর্নেল তাজ, ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, লে. কর্নেল ফাতেমী, ব্রিগেডিয়ার জিলানী ও মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হোসেন আনসারী। এদের কাছে অ্যাডমিরাল আহসান যিনি কিনা '৭০-এর নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর ছিলেন এবং জেনারেল ইয়াকুব যিনি কি না জোন 'বি' মার্শাল ল' প্রধান ছিলেন, তাঁরা দুজনই রাতারাতি খলনায়ক হয়ে গেলেন। এই সময় যে বিমানে করে পাকিস্তানি সেনা আনা হচ্ছিল, সেই বিমান উড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেন দুই বাঙালি তরুণ। তাঁরাই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন। পাকিস্তানি জেনারেলদের সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরে অবস্থানরত বাঙালি সেনারা সতর্ক হয়ে যান। তাঁদের পক্ষ হয়ে একদিকে যেমন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান লে. কর্নেল মাসুদ ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান এম আর চৌধুরী, ইবিআরসির প্রধান ব্রিগেডিয়ার মজুমদার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, তেমনি নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান। ৪ মার্চ থেকে যেসব সেনা অফিসার সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের জন্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর রফিক, মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন হারুন-অর-রশিদ, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন। এই অফিসারদের সঙ্গে জেসিও-এনসিওরাও তাঁদের মতামত আদান-প্রদান করেন। '৭১-এর ৪ মার্চ, ৮ মার্চ, ১৭ ও ১৮ মার্চ_এই দিনগুলোয় গোপন মিটিংয়ের মাধ্যমে তাঁরা প্রতিরোধ পরিকল্পনা ঠিক করেন।
১৯ মার্চ ঢাকার কাছে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হচ্ছে_এমন গুজবের মুখে জয়দেবপুর বাজারের কাছে প্রায় ৫০ হাজার সাধারণ মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে ঢাকা থেকে আগত ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব এবং তার সঙ্গী অত্যন্ত শক্তিশালী ৭০ সশস্ত্র সেনাকে আটকে দেয়। এই বীর জনতা টহলরত পাঁচ বাঙালি সেনাকে তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য চাপ দেয়। এ সময় তারা সম্মত না হলে তাদের বন্দি করে তাদের অস্ত্র ছিনতাই করে জনগণ। এবং তা নিয়ে জনগণ প্রতিরোধ যুদ্ধে শরিক হওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ সময় প্রায় ৫০ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাকমান্ডোর ছদ্মবেশে পূর্ব পাকিস্তানের নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অবাঙালি বসতির মধ্যে আস্তানা গাড়ে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে। এদের মধ্যে যে পাকিস্তানি অফিসারদের শনাক্ত করা হয়, তারা ছিল পাকিস্তানি অফিসার লে. তাজ, চিটাগাং পোর্ট অফিসার মেজর রিজভি। এই দুজন পাকিস্তানিকে মেজর রফিকের অধীন ইপিআরের গোয়েন্দা বাহিনী অনেকটা হাতেনাতে শনাক্ত করে। ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের কতিপয় জওয়ান ও অফিসারসহ লে. কর্নেল ফাতেমিও মার্চের শুরু থেকে এই কাজে সম্পৃক্ত ছিল এবং ৩ মার্চ চট্টগ্রামের বিহারি-বাঙালি দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল বলে মেজর জিয়া এবং ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার জানান।
এরা অবাঙালিদের হয়ে একটি ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বাঙালিদের স্বাধীনতা তথা অসহযোগ আন্দোলনকে একটি জাতিগত দাঙ্গার চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণে অধিকাংশ নিহত বাঙালির শরীরে সামরিক অস্ত্রের আঘাত পাওয়া যাচ্ছিল। ৩ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আহত বাঙালিরা এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের সংখ্যাও আহতদের অনুপাত নির্ধারণ করে। এত চক্রান্তের মধ্যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণাকে বাঙালি সামরিক সদস্যরা একটি 'গ্রিন সিগন্যাল' বলে মনে করেন। এ সময় বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। ২১ মার্চ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান চট্টগ্রামে গেলে সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ফাতেমিকে বললেন, 'ফাতেমি, দ্রুত, ক্ষিপ্রগতিতে, যত কম সম্ভব লোক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে।' এ কথাগুলো শুনেছিলেন মেজর জিয়া। তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি শীর্ষ অফিসার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আর মজুমদারকে কৌশলে ঢাকা এনে বন্দি করা হলো। ওই দিন রাতে মেজর রফিক নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পাহাড়ে অবস্থান নেন এবং জনৈক হক সাহেবের মাধ্যমে টেলিফোনে হালিশহরের ইপিআর হেডকোয়ার্টারে এমন একটি মেসেজ দেন, যাতে দেশের সব ইপিআর সতর্ক হতে পারে। এর আগে ১৯ মার্চ কুরিয়ার মারফত ঢাকার পিলখানায় ক্যাপ্টেন দেলোয়ারকে প্রস্তুতি নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন মেজর রফিক। সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিকে চিরকুটে যে উত্তর ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ফেরত পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল নিম্নরূপ_'Discussed with Bara Karta (Top boss). Not willing.'' এর পরও কোনো কিছু থেমে থাকেনি। ২৪ মার্চ রাতে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান একটি অটোরিকশা নিয়ে মেজর রফিকের কাছে উপস্থিত হন এবং মেজর রফিককে প্রথম আঘাত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানকে উদ্দেশ করে মেজর জিয়া বলেন, 'Don't worry', 'they will not go to that extent'. ওই সময় লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী মেজর জিয়ার ধারণাকে সমর্থন করেন এবং বলেন, 'You must stop your men from taking a� immediate actions'_এই আঘাত থেকে বিরত থাকার কারণে ইবিআরসি এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত সেনা অফিসার ও জওয়ানদের একটি বিরাট মূল্য দিতে হয়। তবে নিরস্ত্রকে আঘাত করার কারণে পাকিস্তানি সেনারা নিজের কাছে এবং বিশ্বের কাছে নৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে পরাভূত হয়।
'৭১-এর ২৫ মার্চের সকাল ১১টায় সব অবাঙালি পাকিস্তানি সেনা অধিনায়ককে রংপুরে ডাকা হয়। তাদের সবার হাতে অপারেশন সার্চলাইটের অর্ডারটা হস্তান্তর করা হয়। ওই অর্ডারে ছিল বাঙালি নিধনের খুঁটিনাটি সব নির্দেশ। ওই সময় সার্ভিসে থাকা সব সেনা সদস্যসহ যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জোগাচ্ছিলেন এবং বিভিন্ন গোপন মিটিংয়ে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে চলছিলেন, তাঁরা এক মহাসংকটে পড়লেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, কর্নেল মাসুদ, লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীসহ অনেক সেনা অফিসার ২৪ মার্চ '৭১-এর একটি বিশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার একটি নির্দেশের (বঙ্গবন্ধুর) অপেক্ষায় ছিলেন। শীর্ষ বাঙালি সেনা অফিসাররা অন্তরীণ অথবা চাপের মুখে নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি সশস্ত্র উদ্যোগ আশা করেছিলেন। সে স্বপ্ন বা আশা অনুযায়ী রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো না এগোলেও সব সক্রিয় সেনা অফিসার, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররাও জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। স্বাভাবিক কারণে জেনারেল ওসমানী ইতিবাচক কোনো সংকেত দিতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তার পরও যে যাঁর মতো করে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলেন এবং ঘটনাগুলোর ওপর নজর রাখছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৫ মার্চ সন্ধ্যার দিকে ইকবাল হলে জমায়েত হন। ইকবাল ও জগন্নাথ হলে কয়েকটি ডামি রাইফেল রাখা ছিল। এ ছাড়া কিছু মলটেভ ককটেল ছিল। আসলে ওগুলো পেট্রল ভর্তি কাচের বোতল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে পাড়ায় পাড়ায় কিছু বন্দুক ও পয়েন্ট টু টু রাইফেল সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ ছাড়া পুলিশের 'থ্রি নট থ্রি' রাইফেলগুলো ছিল। বন্দুকের দোকান, টঙঞঈ ও থানার রাইফেলগুলো স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে ছিল। অবসরে অথবা রিজার্ভে থাকা সেনা ও পুলিশরাও এদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আক্ষরিক অর্থে জনগণের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সেন্টারের এক প্লাটুন পুলিশ সদস্য তাঁদের অস্ত্রসহ লেখকের সঙ্গে রাত ৯-১০টায় প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। আমি নিজে, শহীদ লে. সেলিম এবং পুলিশ সদস্যরা ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, 'সার্ভে অব ইস্ট পাকিস্তান' অফিসের ছাদ এবং সাতরাস্তার মোড়ে অবস্থান নিই সন্ধ্যা থেকে। বড় বড় স্যুয়ারেজ পাইপগুলো আড়াআড়িভাবে ফেলা হয় কারওয়ান বাজার রেলগেট থেকে শুরু করে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পর্যন্ত। এমন প্রতিরোধ তৈরি করা হয়, হোটেল সালমার থেকে বর্তমান ফার্মগেট ওভারব্রিজ পর্যন্ত। এ ধরনের প্রতিরোধ ছিল শাহবাগ, টিএসসি, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, এলিফেন্ট রোড, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোড, পিলখানা, রাজারবাগ, মৌচাক ইত্যাদি এলাকায়।
লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.