চলতি পথে-জীবনের জয়গান, যৌবনের জয়গান by দীপংকর চন্দ

আগের রাতে প্রকৃতির আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। প্রবল বাতাসের প্রশ্রয়ে তা বেড়েছিল উত্তরোত্তর। বৃষ্টি-বাতাসের এই যূথবদ্ধ প্রয়াস সীমাহীন সমুদ্রের বিপুল জলরাশিকেও প্রলুব্ধ করেছিল আদিম উল্লাসে মেতে উঠতে।


প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক আচরণে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম এলজিইডি বাংলোর নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে আসতে। তীব্র উত্কণ্ঠা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অসময়োচিত নিদ্রার কোলে সমর্পিত করেছিলাম নিজেদের।
পরদিন সকাল হতেই প্রকৃতি অপাপবিদ্ধ শিশুর মতোই উজ্জ্বল, উচ্ছল, প্রাণবন্ত। বাতাসের আচরণ শান্ত, সমাহিত। সুতরাং আরও কিছুক্ষণ ঘুমানোর ইচ্ছে পরিত্যাগ করে বাংলো থেকে নেমে এলাম আমরা। সৈকতের স্নিগ্ধ বালুকাবেলায় পা রাখতে না রাখতেই দেখা হলো আব্বাস হাওলাদারের সঙ্গে। গঙ্গামতীর দ্বীপে বাস করা এই শীর্ণ মানুষটি মাছভর্তি হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছেন কুয়াকাটা মত্স্য আড়তে। কী ধরনের মাছ আছে তাঁর হাঁড়িতে? আলস্য জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলাম আমরা। ‘পোয়া, চান্দাগুঁড়া, ব্যোম মাইট্টা...’ বলতে বলতে আমাদের পাশ কাটিয়ে দূরে চলে গেলেন আব্বাস হাওলাদার। আমরা তাঁর গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সমুদ্রের দিকে চোখ ফেরালাম। সুবিশাল আকাশের সঙ্গে সমুদ্রের অন্তর্লীন সম্পর্কের যোগসূত্রটি অনুধাবনের চেষ্টা করলাম একাগ্র চিত্তে। সামান্য সময় অতিক্রান্ত হলো এভাবেই। তারপর বিরক্তিকর এক যান্ত্রিক শব্দের অনুপ্রবেশে বাধাগ্রস্ত হলো একাগ্রতার বুনন। জাকির হোসেন নামের একজন পঁচিশোর্ধ্ব যুবকের মোটরসাইকেল অনেকটা আকস্মিকভাবেই গা ঘেঁষে দাঁড়াল আমাদের। আমরা চমকে উঠলাম। কারণ নগরে এই বাহনটির অপব্যহারের হার অধিক। কর্মহীন যুবসমাজের একটি বিশেষ অংশ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে যান্ত্রিক এই বাহনটিকে। প্রজাতন্ত্রের নিরীহ নাগরিকেরা তাই এই বাহন এবং বাহনের চালক সম্পর্কে পোষণ করেন এক ধরনের আশঙ্কিত মনোভাব। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলাগুলোয় প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাহন হিসেবে পরিচিত এই মোটরসাইকেল নিয়ে শঙ্কার সুযোগ তুলনামূলক কম। পটুয়াখালী, বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মহীন অসংখ্য যুবকের কাছে সত্ভাবে অর্থ উপার্জনের অন্যতম অবলম্বন এই মোটরসাইকেল।
সে যা-ই হোক, মোটরসাইকেল থামিয়ে জাকির হোসেন বেশ বিনীতভাবেই কাছে এলেন আমাদের। স্বল্প ভাড়ায় সৈকত ঘুরিয়ে দেখার প্রস্তাব জানালেন। একটু ভেবে সম্মত হলাম আমরা, তবে সৈকতে নয়, সবিনয়ে জ্ঞাপন করলাম সাগরবিধৌত কুয়াকাটার লোকালয় পরিভ্রমণের ইচ্ছে। জাকির হোসেনের আপত্তি নেই তাতে। তিনি তাঁর যন্ত্রযানে বসালেন আমাদের। তারপর শুরু করলেন যাত্রা। কেরানীপাড়া, রসুলপুর, মিশ্রিপাড়া, লক্ষ্মীর বাজার, আলীপুর বাজার ঘুরে আবার আমরা ফিরে এলাম কুয়াকাটা সৈকতসংলগ্ন বাজারে। বাজারে পৌঁছেই ভাড়া মিটিয়ে জাকির হোসেনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া যেত, কিন্তু ব্যতিক্রমী এই পেশায় জড়িত থাকা সুদর্শন যুবকটির সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছে হলো আমাদের। জাকির হোসেনের হাতে যেহেতু কাজ ছিল না তেমন, তাই তিনি আমাদের এই ইচ্ছেপূরণে রাজি হলেন সানন্দে। বেড়িবাঁধের ওপর মো. ইউসুফের চায়ের দোকানে বসলাম আমরা। গরুর খাঁটি দুধে তৈরি গরম চায়ে গলা ভেজাতে ভেজাতে শুরু করলাম কথোপকথন।
জাকির হোসেনের বাড়ি কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা গ্রামেই। লতাচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনেই থাকেন তাঁরা। বাবা মো. ইউনুস মুন্সি কৃষিজীবী। যে জমিটুকু চাষ করেন তাঁর বাবা, নির্ভাবনায় সাংবাত্সরিক খোরাক চলে তাতে। কিন্তু সংসারের অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য নগদ অর্থও যে চাই প্রতিদিনই! সেই অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য কিছু জমি বিক্রি করে কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিমাংশের শুঁটকি বাজারে আড়ত নিয়েছিলেন জাকির হোসেন। বেশ ভালো অঙ্কের টাকাও বিনিয়োগ করেছিলেন ব্যবসায়। কিন্তু সিডর ও আইলার মতো দু-দুটো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সমস্ত পুঁজি বিনষ্ট হওয়ায় তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডের ক্ষয় চরমে পৌঁছায়। সেই ক্ষয় পূরণের লক্ষ্যে আরও কিছু ফসলি জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়া পাঠানো হয় জাকির হোসেনের ছোট দুই ভাইকে। কিন্তু ফণা উঁচিয়ে থাকা ব্যর্থতা এবারও দংশন করে সেই উদ্যোগের ভিত্তিমূলে। স্বভাবতই ভীষণ দুর্দিন নেমে আসে জাকির হোসেনের পরিবারে। ঠিক সে সময় এক বন্ধুর পরামর্শে বরিশাল সদরে যান জাকির হোসেন। স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কিস্তিতে মোটরসাইকেল কিনে এনে কুয়াকাটায় ভাড়ায় চালানো শুরু করেন। সেই মোটরসাইকেল চালিয়েই আজ তাঁর দৈনিক উপার্জন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর কিস্তির টাকা? চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে জানতে চাই আমরা। ‘হ্যাঁ, কিস্তির টাকাও প্রায় শোধের পথে। আর মাত্র কয়েকটা মাস, ব্যস!’ তারপর এই মোটরসাইকেলের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হবে তাঁর নিজের নামটি। নিকট ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নজাল বুনতে বুনতে এবার উঠে দাঁড়ান জাকির হোসেন। উঠে দাঁড়ানোর কারণ আর কিছুই নয়, নতুন একজন যাত্রী তখন অপেক্ষমাণ তাঁর মোটরসাইকেলের সামনে!

No comments

Powered by Blogger.