জন্মদিন-জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি by আশরাফুল হক

নীরবতাই প্রার্থনা/ প্রার্থনাতেই বিশ্বাস জন্মায়/ নিবিড় বিশ্বাস ভালোবাসার উৎস/ গভীর ভালোবাসাই সেবার ভিত্তি/ সেবাতেই শান্তি —মাদার তেরেসা উচ্চারণগুলো ভালোবাসার, শান্তির। পৃথিবীতে যে অল্প কিছু মানুষ মানুষকে ভালোবেসে মানুষের শান্তির জন্য, সার্বিক অর্থে মানবকল্যাণের জন্য জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করে গেছেন, তাঁদের অন্যতম মাদার তেরেসা। আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।


আজকের এই দিনে তাঁকে আমরা স্মরণ করতে পারি তাঁর কিছু বাণী ও কর্মের মাধ্যমে। ‘দ্য পুওর মাস্ট নো দ্যাট উই লাভ দেম’—মাদার তেরেসা ুআজীবন এ কথা বলেছেন, বিশ্বাস করেছেন এবং চর্চা করেছেন।
মাদার তেরেসা যে শুধু অর্থনৈতিক দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতেন তা নয়; যারা নানা কারণে মানসিক কষ্টে অসহায় জীবন যাপন করেছে, তাদের কষ্ট, তাদের অসহায়ত্ব কীভাবে দূর করা যায়, তা ছিল মাদার তেরেসার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই কষ্ট, এই অসহায়ত্ব দূর করার জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন এবং এটিকে তিনি অনেক বেশি কঠিন মনে করতেন। এ সম্পর্কে নোবেল বক্তৃতায় মাদার তেরেসা বলেন, ‘শুধু দরিদ্র দেশগুলোতে নয়, পশ্চিমা দেশগুলোর সমস্যা দূর করা আরও কঠিন। রাস্তার ক্ষুধার্ত একজনকে ডেকে এনে এক প্লেট ভাত, এক টুকরো রুটি দিয়ে আমি তার ক্ষুধা নিবারণ করে সন্তুষ্ট হতে পারি। কিন্তু সমাজ যাকে পরিত্যাগ করেছে, সে ভালোবাসাবঞ্চিত, সমাজে সে অনাকাঙ্ক্ষিত, সে ভীত, তার অবস্থা অনেক বেশি করুণ। তার জন্য সত্যিকার অর্থে কিছু করা সত্যি দুরূহ।
হ্যাঁ, মাদার তেরেসা ছিলেন ভালোবাসাবঞ্চিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ভীত ও অসহায়দের বন্ধু। তিনি ছিলেন আশ্রয়হীনদের আশ্রয়দাত্রী। তিনি ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ছাড়া চেরনোবিল তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত, ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষপীড়িত, আর্মেনিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর অন্যতম।
মাদার তেরেসা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এ দেশের দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করেছেন। আবার স্বাধীনতার পর বহু বীরাঙ্গনা ও তাঁদের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানদের আশ্রয় দিয়েছেন। এমনি আরও অনেক কাজের সঙ্গে তিনি ও তাঁর গড়া সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ যুক্ত ছিল। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এসবের মধ্যে ১৯৬২ সালে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৭১ সালে পোপ জন পল শান্তি পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে পাওয়া ভারত সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন উল্লেখযোগ্য।
নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় মাদার তেরেসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কীভাবে আমরা বিশ্ব শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারি?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘গো হোম অ্যান্ড লাভ ইয়োর ফ্যামিলি।’ (নিজের দেশে ফিরে যাও, নিজ পরিবারকে ভালোবাস)। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা বাস করেন। আমি যখন কোনো কুষ্ঠরোগীর ক্ষত পরিষ্কার করি, তখন অনুভব করি, আমি যেন স্রষ্টারই সেবা করছি। এর চেয়ে সুখময় অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে!’
মাদার তেরেসার বলা কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যায় এখানে। তাতে তাঁকে বোঝা সহজ হবে। ‘যদি তুমি সৎ ও সরল মানুষ হও, তাহলে মানুষ তোমাকে ধোঁকা দেবে। কিন্তু তার পরও তুমি সৎ ও সরল থেকো।’
‘বছরের পর বছর ধরে তুমি যা গড়ে তুললে, এক রাতের মধ্যেই কেউ তা ভেঙে দিতে পারে, তার পরও গড়ে তুলতে থাকো।’
‘জীবনে শান্তির খোঁজ পেলে অন্যরা তোমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হবে। তার পরও সুখী হও।’
‘মানুষের জন্য তুমি যে ভালো কাজ করছ আজ, কালই মানুষ তা ভুলে যাবে। তার পরও ভালো কাজ করে যাও।’
মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট মেসিডোনিয়ার আলবেনিয়ান এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মিশনারি কাজের প্রতি শৈশবেই তাঁর অনুরাগ জন্মায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি এ কাজে যোগ দিতে ইচ্ছা পোষণ করেন এবং ১৮ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে ‘সিস্টার অব লরেটো’তে যোগ দেন। তার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাননি। ১৯২৯ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। ১৯৫০ সালে ভ্যাটিকানের অনুমতি নিয়ে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’। বর্তমানে বিশ্বের ১২৩টির মতো দেশে এর শাখা রয়েছে। এসব শাখায় চার হাজারের বেশি সিস্টার মানবতার সেবায় কাজ করছেন। বাংলাদেশেও এর বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে। মাদার তেরেসা ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

No comments

Powered by Blogger.