চারুশিল্প-শিল্পগুরুকে শ্রদ্ধাবনত স্মরণ by জাফরিন গুলশান

শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ (১৯২২-২০১২) তাঁর জীবনব্যাপী শিল্প সাধনা দ্বারা স্বাধীনতাপরবর্তী বাঙালি জাতিকে বিশ্বের সামনে গৌরবময় স্থান করে দিয়েছেন। সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ-এর ৭০টি শিল্পকর্ম নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারী অব ফাইন আর্টস আয়োজন করেছে: শ্রদ্ধার্ঘ্য: শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ শিরোনামে এক বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী।


শিল্পী বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ছাপচিত্র মাধ্যমের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ব্যক্তিদের অন্যতম। ছাপচিত্র মাধ্যমকে উৎকর্ষ মণ্ডিত করার পাশাপাশি রেখাচিত্র, তেলচিত্র নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলন করে গেছেন জীবনব্যাপী।
প্রদর্শনীতে শিল্পীর শিক্ষা জীবনের কিছু জলরং চিত্র বিভিন্ন সময়ে করা রেখাচিত্র, তেলরং-এ করা প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমের অসাধারণ কাজ রয়েছে। রেখা চিত্রের (ড্রইং) দক্ষতা একজন চিত্রশিল্পকে পড়বার জন্য বেশ ভালো উপাদান। রেখার সরলতা, সততা ও দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করে শিল্পীর মনোজগতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে। সফিউদ্দীন আহমেদের কাজে টোনাল ড্রইং, মিক্স মিডিয়া ড্রইং, টোনাল ভেরিয়েশন ইত্যাদির সঙ্গে দেখা যায় জলরং-এর ওয়াশও। এই টোনাল ভেরিয়েশন-এর মাধ্যমে রেখাচিত্র করার অন্যতম কারণ ছাপচিত্র মাধ্যমের জন্য বিশেষ চিন্তা করা। শিল্পীর ১৯৬০-৬৮ কালপর্ব, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ কাল পর্বে আঁকা রেখাচিত্রগুলোতে বিষয়গত নীরিক্ষার সৃজনশীল পরিবর্তন প্রতীয়মান।
প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীন আহমেদ এর- যে সব জলরং-এর চিত্র আছে সেগুলো ছাত্রজীবনে করা, মূলত অনুশীলনীধর্মী। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কর্তৃত্বপরায়ন ব্রিটিশ কৌশল এর সঙ্গে নব্যবঙ্গীয় ধারার ওয়াশ তাঁর জলরংগুলোতে স্পষ্ট।
তেলচিত্রগুলোর প্রায় সবগুলো ১৯৪৪-৪৫ সালের। এগুলো এঁকেছেন দুমকা ভ্রমণকালে, আউটডোর স্টাডি হিসেবে। ফলে এগুলোতে ছোট ব্রাশ স্ট্রোকে রঙের ঘন প্রলেপের সঙ্গে দ্রুত হাত চালনার গতি বিদ্যমান। রং ব্যবহারে সফিউদ্দীন আহমেদের আগ্রহ খুব পরিশীলিত ও পরিমার্জিত। ১৯৭২ সময়কালে করা কাজগুলোতে অসামান্য নান্দনিক রুচিবোধের প্রকাশ দেখা যায়। স্প্যাচুলা দিয়ে টেক্সচারের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষনীয়। চিত্রের আঙ্গিকে জ্যামিতিকভাবে অবয়ব নির্মাণের প্রয়াস এবং পেছনের উপরিতলের সরলীকরণ একমাত্রিক নির্মাণ দেখা যায়। কিছুটা কিউবিস্ট ধারার সরলীকরণ প্রক্রিয়া। উদাহরণ হিসেবে নাম করা যায় বুক শাপ ইন প্যারিস (১৯৬০) ফ্লাড (১৯৮৮) স্টিল লাইফ-৩ (১৯৪৭)।
একাত্তরের স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিক নেতৃত্বের জন্যও অগ্নি পরীক্ষা হাজির হয়। এই হতবিহ্বলতার মধ্যে কলকাতা থেকে দেশ বিভাগের সময় চলে আসা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের চারু ও কারু শিল্পচর্চা নতুন পরিচয় তৈরি করার প্লাটফর্ম পেয়ে যায়। শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ শিল্পচার্যের নেতৃত্বে চারুকলা শিক্ষায় ছাপচিত্র মাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক পথ প্রসারিত করেন।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্র মাধ্যমের শিল্পকর্মগুলো তৎকালীন বাংলাদেশের চিত্রচর্চার আদলের বাইরে যোগ করে নতুন, আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মাত্রা।
উড এনগ্রেভিংয়ে শিল্পীর খুব জনপ্রিয় একটি চিত্রকর্ম সাঁওতাল মেয়ে। ১৭×১০ সে.মি. মাপে সাদা কালোতে রঙে করা শিল্পকর্মটি ১৯৪৬ সালের। দুই রমণীর কলসীতে জল সংগ্রহের ভঙ্গিমার সঙ্গে শিল্প সৌকর্যে অঙ্কিত হয়েছে বনভূমি সদৃশ প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিভিন্ন ধরনের উড এনগ্রেভিং টুলসের সর্বোত্তম ও পরিমার্জিত ব্যবহারে রমণী দেহের ত্রি-মাত্রা, কাপড়ের ভাঁজ, জলাধারে জলের কম্পন, পেছনে বৃক্ষরাজির পাত্রার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুপরিকল্পিত দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত আলো-ছায়াকে বিভিন্ন টোনাল ভেরিয়েশনে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। এছাড়া ১৯৪৭ সালে আঁকা মেলার পথে (অন দ্য ওয়ে টু দি ফোয়ার) শিল্পীর অরেকটি বিখ্যাত উড এনগ্রেডিং। তাঁর এ সব উড এনগ্রেডিং শিল্প শিক্ষার্থীদের জন্য টেক্সট বই স্বরূপ।
অন দ্য ওয়ে (১৯৪৩), ভিউ ফ্রম শান্তিনিকেতন (১৯৪৫) উল্লেখযোগ্য এ ছবি দুটিশিল্পী এঁকেছেন ড্রাইপয়েন্টে। ড্রাইপয়েন্ট মাধ্যমের চমৎকারিত্ব ও সফলকাম উপসংহার এই ছবি দুটির বিশেষত্ব।
১৯৬৬ সালের পরে সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্রে পরিবর্তন আসে। এ সময়ে প্রবলভাবে রঙের প্রবেশ ঘটেছে তাঁর ছবিতে। এরপর থেকে প্রচুর এচিং-একুপেটিন্ট এবং পরবর্তীতে কপার এনগ্রেডিং-এর মাধ্যমে অমূল্য, অসাধারণ কিছু কাজ করেছেন শিল্পী। বিফোর স্ট্রম (১৯৫৬), রিসিডিং ফ্লাড (১৯৫৯), ফিশিং টাইম (১৯৫৭) ইত্যাদি ইন্টারগ্লিও প্রসেসের ছাপ চিত্রকর্মে মূল পরিবর্তনটা দেখা যায় কর্ম বা আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে। অবয়বের ব্যাপক ভাঙচুর, বিবিধ দৃষ্টিতে পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার, সংক্ষেপায়িত রং ও কর্ম ইত্যাদি সফিউদ্দীন আহমেদের কাজের শক্তিমত্তাকে ফুটিয়ে তুলে । এ পর্বে শিল্পী, চোখ আঁকতে থাকেন কপার এনগ্রেডিং মাধ্যমে, কান্না সিরিজের আবির্ভাব তখুনি। প্রচণ্ড গতি ও শক্তিশালী রেখার প্রকাশে ওই চোখ হয়ে উঠেছে বাঙালীর জাতীয় পরিচয়ের দৃপ্ত স্বাক্ষর।
ছাপচিত্র মাধ্যমটি সহজ নয়। এর জন্য ব্যাপক ধৈর্য্য এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের মহাপ্রয়াণ নবীন প্রজন্মের ছাপচিত্র মাধ্যমের শিক্ষার্থী, সর্বোপরি বাংলাদেশের জাতীয় চারুশিল্পকলার ইতিহাসের অগ্রজতম পর্বের অবসান। কিন্তু তাঁর ছাপচিত্র মাধ্যমের প্রজ্ঞা, ব্যাকরণ, সৃজন বৈভব ও ছন্দ চিরঅনুসরণীয়, পাথেয় নবীন প্রজন্মের জন্য। একজন মহান শিল্পীর দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন সততার সঙ্গে। তাঁর ব্যক্তিত্ব শিল্পকর্ম বর্তমান প্রজন্মের দিশাহীনতাকে দিশা দিবে। কারণ, শিল্প শিল্পের জন্য তত্ত্ব ছাপিয়ে শিল্প মানবজাতির পক্ষে শুভ ও কল্যাণের বলেই চূড়ান্তভাবে গৃহীত। প্রদর্শনী ১৬ জুন পর্যন্ত চলবে।

শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯২২ সালের ২৩ জুন ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে চারুকলায় স্নাতক এবং ১৯৫৮ সালে যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস থেকে এবং এনগ্রেডিং এ সম্মানের সঙ্গে ডিপ্লোমা করেন। তিনি দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতা একাডেমী অব ফাইন আর্টস প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট পদক: ১৯৪৭ সালে ভারতে দ্বারভাঙ্গা মহারাজা পদক: ১৯৬৩ সালে চারুকলায় অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত ‘প্রেসিডেন্ট পদক’, ১৯৭৮ সালে চারুকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদক, ১৯৯৬-তে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ৭৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর কাজ সংগৃহীত হয়েছে। গত ২০ মে ২০১২ এই পিতৃপ্রতীম শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ ইন্তেকাল করেন।

No comments

Powered by Blogger.