নিরাপদ খাবার-আমাদের শিশুরা কী খাচ্ছে by মশিউল আলম

আমাদের দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে যত কথা হয়, নিরাপদ খাদ্য নিয়ে তত হয় না। গরিব দেশের মানুষের সংবৎসরের খাদ্যচাহিদা মেটানোর ব্যবস্থার কথা অবশ্যই ভাবতে হয়। সে জন্য খাদ্যনিরাপত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।


আমরা প্রতিদিন কী খাচ্ছি, তা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কি না, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের নজর সেদিকে নেই।
২০০৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধে গুঁড়ো দুধে ক্ষতিকর মাত্রায় মেলামিন ধরা পড়ার খবরে এ দেশে কিছুটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল; চাঞ্চল্যের উৎস ছিল চীন দেশ। ওখানে মেলামিনযুক্ত গুঁড়ো দুধ খেয়ে মারা গিয়েছিল ছয় শিশু, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল প্রায় তিন লাখ। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধ আমদানি করা হয় চীন থেকে। তাই আমাদের এখানেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল যে আমাদের শিশুদের যেসব গুঁড়ো দুধ খাওয়ানো হচ্ছে সেগুলো ম্যালামিনমুক্ত কি না। আদালতে রিট হয়েছিল, বাজার থেকে গুঁড়ো দুধের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল, নানা রকম ফলাফলের কথা জানা গিয়েছিল, শেষে আদালত আদেশ দিয়েছিলেন বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধের নমুনাগুলো পরীক্ষা করে আনার। দুটি কোম্পানির গুঁড়ো দুধে নিরাপদ মাত্রার বেশি মেলামিন ধরা পড়েছিল, সেগুলোর বিক্রি নিষিদ্ধ করা ও বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে বিষয়টি হারিয়ে গেছে। এখন আর এ প্রসঙ্গে কোথাও কোনো কথা নেই। আমরা ভুলে গেছি, যেমন করে ভুলে যাই অনেক গুরুতর সমস্যার কথা।
কিন্তু চীন দেশের লোকজন ভোলেনি; ওখানে খাদ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে নজরদারি একটা নিয়মিত ব্যাপার। গত মাসে চীনা বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, দেশটির কিংহাই প্রদেশে রাষ্ট্রীয় খাদ্যনিরাপত্তা তদারকি সংস্থা একটি ডেইরি কারখানা থেকে মেলামিনযুক্ত ৬৪ টন দুধ ও দুধজাত খাদ্য জব্দ করেছে। এবং কারখানার তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। মনে পড়ছে, ২০০৮ সালের মেলামিন কেলেঙ্কারির বিচারে হেবেই প্রদেশের এক ডেইরি প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছিল। গত বছর নভেম্বরে ওই দুই কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে; আর সানলু নামের ডেইরি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় লালবাতি জ্বলেছে। মেলামিন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ২২টি ডেইরি প্রতিষ্ঠানকে অসুস্থ শিশুদের পরিবারগুলোকে শত শত কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছিল চীন সরকার। তাদের সব মেলামিনযুক্ত ডেইরিপণ্য ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিল। কিন্তু গোপনে সেই নির্দেশ অনেক প্রতিষ্ঠানই এড়িয়ে গেছে, তার একটা প্রমাণ হিসেবে এবার ধরা পড়ল কিংহাই প্রদেশের একটি ডেইরি প্রতিষ্ঠানের ৬৪ টন ডেইরিপণ্য। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ও সেফ ফুড এক্সপার্টরা লিখছেন, চীনে দুধসহ পুষ্টিবর্ধক নানা খাদ্যপণ্যে প্রোটিনের মাত্রা বেশি দেখানোর লক্ষ্যে নিরাপদ মাত্রার বেশি মেলামিন মেশানো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। গত জানুয়ারিতে বিবিসি সাংহাই থেকে খবর পাঠিয়েছিল, সেখানে সাংহাই পান্ডা ডেইরি কোম্পানি নামের এক প্রতিষ্ঠানের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিচার শুরু হতে যাচ্ছে, কারণ তাদের কোম্পানির পণ্যে অতিরিক্ত মেলামিন ধরা পড়েছে। বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল, পান্ডা ডেইরি কোম্পানি তাদের পণ্যে ম্যালামিন মেশাচ্ছে, এ খবর তারা পেয়েছিল ২০০৮ সালের শেষে, যখন প্রথম ম্যালামিন কেলেঙ্কারির অবসান হতে যাচ্ছিল। তারা পান্ডা ডেইরির ওপর তদন্ত শুরু করে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এ বিষয়ে জনসমক্ষে কিছু জানায়নি, পান্ডার ডেইরিপণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশও দেয়নি। নীরবে বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনা কর্তৃপক্ষ এটা করেছিল এ জন্য যে অল্প কিছুদিন আগেই ম্যালামিন কেলেঙ্কারির ফলে গোটা দেশের ডেইরিশিল্পের যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আরেক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে পড়লে তা হবে চীনা অর্থনীতির জন্য বেশ ক্ষতিকর। কারণ চীনা ডেইরি কোম্পানিগুলোর পণ্য শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারেই বিক্রি হয় না, বহির্বিশ্বেও তাদের বিরাট বাজার রয়েছে। ২০০৮ সালের মেলামিন কেলেঙ্কারির পর যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) চীন থেকে সব ধরনের খাদ্যপণ্য যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার ব্যাপারে নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, এফডিএর বিশেষজ্ঞরা চীনে গিয়ে সে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা পরিদর্শন করেছিলন এবং এই সুযোগে এফডিএ বেইজিং ও সাংহাইসহ চীনের ছয়টি শহরে স্থায়ী অফিস খুলে বসেছে। চীন তাতে খুশি হয়নি, কিন্তু বাদও সাধতে পারেনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের খাদ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ হওয়া বা কমে যাওয়ার অর্থ হবে বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা আয়ের পথ হারানো।
এবার কিংহাই প্রদেশে মেলামিনযুক্ত ডেইরিপণ্য আটক ও তিন কর্মকর্তার প্রেপ্তারের খবর নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। তারা বলার চেষ্টা করছে, ২০০৮ সালের মেলামিন কেলেঙ্কারির পর চীন সরকার মেলামিনযুক্ত যেসব ডেইরিপণ্য ধ্বংস করতে নির্দেশ দিয়েছিল, কিংহাই প্রদেশের একটি ডেইরি কারখানা থেকে আটক ৬৪ টন ডেইরিপণ্য সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কোম্পানিটি সেগুলো ধ্বংস করেনি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বলতে চাইছে, এ রকম অনেক ডেইরি প্রতিষ্ঠান চীনে আছে, যারা সে সময় সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী মেলামিনযুক্ত ডেইরিপণ্য ধ্বংস করেনি। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, সাংহাইয়ের পান্ডা ডেইরি কোম্পানি ও কিংহাইয়ের দোংগুয়ান ডেইরি ফ্যাক্টরি থেকে আটক ডেইরিপণ্যের সঙ্গে ২০০৮ সালের মেলামিন কেলেঙ্কারির কোনো সম্পর্ক নেই। চীনা কর্তৃপক্ষ এবার বেশ জোর দিয়ে ঘোষণা করেছে যে খাদ্যদ্রব্যে মেলামিনদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে তারা আগের চেয়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। চীন স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রসহ বহির্বিশ্বে তার ডেইরিপণ্যের বাজার নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের শিকার হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা আপাতত থাক, তাদের বাজারে বাইরে থেকে ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ঢোকা খুব কঠিন। তারা সীমান্তেই সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তারপর ঢোকার অনুমতি দেয় অথবা ফেরত পাঠায়। বাংলাদেশের বাজারে ডেইরিপণ্য ও পুষ্টিবর্ধক নানা ধরনের শিশুখাদ্য চীন থেকে আসছে বিপুল পরিমাণে। সেগুলো শিশুদের জন্য নিরাপদ কি না—এ প্রশ্ন কি এখন তোলা যায় না? যখন খোদ চীনের শিশুরাই আবারও মেলামিন ঝুঁকির শিকার বলে খবর আসছে? শুধু কৌটাজাত গুঁড়ো দুধ নয়, নানা ব্র্যান্ডের পুষ্টিবর্ধক খাদ্যেও প্রোটিনের মাত্রা বেশি দেখানোর জন্য মেশানো হয় মেলামিন নামের রাসায়নিক পদার্থ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর, এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে। প্রচুর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় এসব পণ্যের। কোনো কোনো পুষ্টিবর্ধক শিশুখাদ্যের বিজ্ঞাপনে এমন কথাও প্রচার করা হয় যে তা খেলে শিশুরা কয়েক ইঞ্চি লম্বা হয়, তাদের বুদ্ধি ধারালো হয় ইত্যাদি (সভ্য দুনিয়ার গণমাধ্যমে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায় না)।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনেক দায়িত্বের একটা হলো খাদ্যপণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেওয়া। আমাদের বাজারে যেসব চীনা ও অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির গুঁড়ো দুধ ও পুষ্টিবর্ধক শিশুখাদ্য বিক্রি হচ্ছে, বিএসটিআইয়ের উচিত হবে সেগুলোর নমুনা আবারও পরীক্ষা করে দেখা। আমাদের শিশুরা কী খাচ্ছে, সেগুলো তাদের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কি না, তা আমাদের জানা উচিত। বিশেষত শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিএসটিআইয়ের নিয়মিত নজরদারি থাকা খুব দরকার।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.