অরণ্যে রোদন-আসুন, লড়াই করি এবং বাঁচি by আনিসুল হক

যেই মেয়েটি স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদে মিছিলে নেমেছিল, প্রতিবাদী মিছিলের পুরোভাগে প্রদীপ্ত ভঙ্গিতে অগ্রসরমাণ যে মেয়েটির ছবি ছাপা হয়েছিল কাগজে, সেই মেয়েটিই কিনা আত্মহত্যা করল বখাটের উৎপাত সইতে না পেরে।


যেই মেয়েটি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নতুন বই গ্রহণ করেছিল, কাগজে ছাপা হয়েছিল যার সেই গৌরবময় মুহূর্তের ছবিটি, সেও কিনা আত্মঘাতী হলো বখাটের উত্ত্যক্ততার কারণে। একটার পর একটা এ রকম অঘটনের খবর, অপঘাতে মৃত্যুর খবর ছাপা হচ্ছে কাগজে। আরও ছাপা হচ্ছে সন্তানসমেত গৃহবধূর আত্মহত্যার খবর। এসব খবর মন ভেঙে দিচ্ছে আমাদের।
এই লেখা যিনি পড়ছেন, তাঁর প্রতি আমার আবেদন, আসুন, এই আত্মহত্যার মিছিল বন্ধ করতে আমরা ভূমিকা রাখি। আমাদের মেয়েরা স্কুলে যাবে, কলেজে যাবে, টিউটরের কাছে যাবে, খেলতে যাবে, কর্মস্থলে যাবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে যাবে, হাটে-মাঠে-ঘাটে যাবে, মাথা উঁচু করে যাবে। কেউ যদি তাদের জ্বালাতন করে, উৎপাত করে, উত্ত্যক্ত করে, তাহলে ওই মেয়েটির কোনো অপমান হয় না, ওই মেয়েটি কোনো অপরাধ করে না, তার মাথা নিচু হওয়ার কোনো কারণ ঘটে না; যে জ্বালাতন করে, সে অপরাধী, অসম্মান যদি কিছু ঘটে, ওই বখাটে ছেলেটির ঘটেছে। মাথা যদি নিচু করতে হয়, ওই ছেলেটি করবে, তার পরিবার করবে, তার অভিভাবকেরা করবেন, আর তাদের প্রতিপালন করেছে যে সমাজ, সেই সমাজের নেতারা করবেন। মেয়েটি এতে বিরক্ত হতে পারে, নিরাপত্তাহীনতাতেও ভুগতে পারে, কিন্তু তাকে বুঝতে হবে, তার জগৎ শেষ হয়ে যায়নি, প্রতিবাদ করতে হবে বেঁচে থেকে, নিজের বাবা-মা স্কুলের শিক্ষকের কাছে সাহায্য চেয়ে। এবং সেখানেই আসবে সমাজের নেতাদের ভূমিকার কথা, সমাজের মুরব্বিদের এগিয়ে আসতে হবে ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য, বাবা-মা যেন ভুলেও মেয়েটিকে নিয়ে হতাশা বা দুঃখ প্রকাশ না করেন। আর সাহায্যপ্রার্থনা মাত্র কঠোরভাবে এগিয়ে আসতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে আয়োজন করেছিল একটা আলোচনা সভার। বিষয় ছিল সমাজে কাউন্সেলরের ভূমিকার গুরুত্ব। ওই সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, যাদের বখাটে বলা হচ্ছে, যারা উত্ত্যক্ত করছে, তারা তো বাইরের কেউ নয়, তারা আমাদেরই কারও না কারও সন্তান। নিজের সন্তান কী করছে, সে দায়দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। বখাটের বিরুদ্ধে, নারীকে উত্ত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে তিনি করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আসুন আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করি। কোনো একজন ছাত্রী যখন বখাটেদের নিপীড়নের লক্ষ্যে পরিণত হয়, আমাদের সেই মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়াই আমরা। তাকে অভয় দিই। তাকে বলি, আমরা তোমার সঙ্গে আছি। তুমি ভয় পেয়ো না। তুমি ভেঙে পোড়ো না। তুমি নিজেকে অসহায় ভেবো না। পুরো দেশ তোমার পাশে আছে।
এই যে অভয়বাণীটা, এটাকে বাস্তব করে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব—নারীর জন্য অভয়ের পরিবেশ, নিরাপত্তার বোধ তৈরি করা। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কঠোর হবে, প্রো-অ্যাকটিভ হবে, মানে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই তারা ব্যবস্থা নেবে, সেই উত্ত্যক্তকারী যত বড় প্রভাবশালীরই ছেলে হোক, সেই উত্ত্যক্ত করার ধরন যত আপাত-নিরীহই মনে হোক। কিন্তু ছেলেদের অভিভাবকদেরও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। আমার নিজের ছেলে কারও জন্য ক্ষতিকর বা ভয়ংকর বা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠেনি তো। তেমনি আমার নিজের আচরণও কি কারও জন্য বড় সমস্যা হয়ে উঠছে? আমি এ কথা বলছি এই আশায় যে আমার লেখা কেউ কেউ পড়েন এবং যাঁরা পড়েন তাঁদের মধ্যে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী তথা শিক্ষার্থীরাও আছেন বলে আমার ধারণা।
তার পরও সমাজে কখনো কখনো বাস্তবতা খুব বৈরী হয়ে ওঠে। মেয়েটি স্কুলে বা কলেজে যেতে পারছে না, বাবা-মা মন খারাপ করে আছেন, সে ক্ষেত্রে আমরা কী করব? আমরা প্রতিবাদ করব, প্রতিরোধ করব। আঘাত যদি করতে হয়, আমরা অপরাধীকে আঘাত করব, নিজেদের ওপরে আঘাতটা নেব না। যেই মেয়েটি ভেবেছিল, আমার কারণে যখন আমার বাবা-মা এত দুশ্চিন্তা করছেন, তাহলে আমিই সরিয়ে দিই নিজেকে পৃথিবী থেকে, বারবার মনে হয়, ওই মেয়েটিকে বলি, কন্যা আমার, বোন আমার, তুমি কী করে ভাবলে, তুমি না থাকলে তোমার বাবা-মায়ের দুঃখকষ্ট দূর হবে। একটা দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচানোর মিথ্যা আশ্বাসে তুমি সারাটা জীবন তাদের অকূল দুঃখের নদীতে কেন ঠেলে দেবে। আবারও বলি, অপরাধ-লজ্জা-অপমান ওই বখাটেটির, তোমার নয়, আসো, লড়াই করি এবং বাঁচি। অভিভাবকদেরও আবার বলি, ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়ান, তাকে অভয় দিন, বলুন যে আপনি তার পাশে আছেন।
আরেকটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা হলো সন্তানদের নিয়ে স্বামীর কারণে, শ্বশুরবাড়ির লোকদের আচরণের কারণে কোনো নারী যখন বিপন্ন ও অসহায় বোধ করছেন, তিনি আত্মঘাতী হচ্ছেন, সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সন্তানদেরও মারছেন। আত্মহত্যা অপরাধ এবং পাপ। সন্তানদের হত্যা করা একটা অকল্পনীয় অপরাধ। যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁরা হিরো নন। এখানে আমার মনে হয়, গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নিজেদের ভাবার দরকার আছে। আমরা কি খবরটা এমনভাবে প্রকাশ বা প্রচার করছি, যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে নারীরা প্ররোচিত হচ্ছেন? যে মা নিজের সন্তানদের গায়ে অগ্নিসংযোগ করে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মা তো কিছুদিন বেঁচে ছিলেন, বেঁচে উঠলে ওই মায়ের যে খুনের দায়ে সাজা পেতে হতো, সেটা তো আমরা সবাই বুঝি। এই খবরটাকে বীরত্বপূর্ণ করে যেন কিছুতেই পরিবেশন না করি।
আবারও বলি, আমাদের সমাজে অনেক দুঃখকষ্ট আছে; বিশেষ করে যে নারী স্বাবলম্বী নন, মধ্য বয়সে হঠাৎ যদি তিনি আবিষ্কার করেন স্বামীর অবলম্বনটা তাঁর কাছ থেকে সরে যাচ্ছে, বিশ্বাসভঙ্গ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিয়ে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা শ্বশুর-শাশুড়ির গঞ্জনায় তিনি যে অসহায় বোধ করেন, তা সহজবোধ্য। আমি একটা নাটক লিখেছিলাম ভালোবাসা মন্দবাসা নামে। তাতে এক স্বামী তাঁর বড় বড় ছেলেমেয়ে ও বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করেন। স্ত্রী ও তাঁর ছেলেমেয়েরা অসহায় হয়ে পড়েন। নাটকটি প্রচারের সময়ে আমি একাধিক নারীর কাছ থেকে ফোন পেয়েছিলাম; তাঁরা বলছেন এটা যেন তাঁদেরই জীবনের সত্যি গল্প। আমি আমার নাটকে ওই স্ত্রীকে শেষে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়েছিলাম। আর দেখিয়েছিলাম, স্বামীটি ব্যবসায় ক্ষতি স্বীকার করে পথে বসে পড়েছেন। নাটকে সবই দেখানো সম্ভব। বাস্তব খুব কঠিন। কিন্তু তার পরও সংগ্রাম তো করে যেতেই হবে। কত নারী অল্প বয়সে বিধবা হন, তাঁরা কি শেষ জীবনে জয়লাভ করেন না? বেঁচে থাকাটা হলো আসল।
এখানে চলে আসে একটা সহানুভূতিশীল কাঁধের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি, যেই কাঁধে মাথা রেখে আমরা একটু কাঁদতে পারব, তারপর কান্না মুছে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পথ চলতে পারব। এখানেই আসে পেশাদার কাউন্সেলরের ভূমিকার কথা। আসে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সাহায্যের কথা। প্রতি থানায় অন্তত একটা টেলিফোন নম্বর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা উচিত, যেখানে একজন নারী তাঁর দুঃখের কথা বলবেন, কোনো অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হলে আইনি সাহায্য চাইতে পারবেন, পেশাদারি কাউন্সেলিং দরকার হলে সেটা লাভ করবেন। মোবাইল ফোনের অভূতপূর্ব উন্নতির যুগে এটা করা খুব কঠিন কিছু নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা যেকোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এটা করতে পারে।
আমরা জানি, আমরা নিপীড়নের শিকার, বৈষম্যের শিকার, কিন্তু আসুন, আমরা বাঁচি। আমরা ঘৃণা করি অত্যাচারীকে, আমরা ধিক্কার দিই নিপীড়নকারীকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে, সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই, কাজ করি, কিন্তু সবার আগে আসুন, বাঁচি।
একটা সমাজ উন্নত কি অনুন্নত, সেটা বোঝা যায় সেই সমাজে নারীর অবস্থা আর অবস্থান দেখে। আমাদের নারীদের খারাপ রেখে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারি না। নারীর শিক্ষা আর স্বাবলম্বিতা খুব বেশি দরকার। নারী যেন পুরুষটিকে ছাড়াও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এ কথাও সত্যি, নিজেকে অসহায় ভাবলেই অসহায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে শিক্ষা বা পুঁজির চেয়েও বেশি দরকার মনের জোর। সেই জোরটাও ছিনিয়েই নিতে হবে। আমি আমার পাঠকদের সেই মনোবলটা দেখিয়ে দেওয়ার আবেদন জানাই। আসুন, আমরা লড়াই করি আর বাঁচি। আমাদের বিরূপ প্রতিকূল পরিবেশটাকে বদলের লড়াইয়ে সাহসিকতা দেখাই, ভীরুতা নয়। খারাপ দিন সবারই আসে, কিন্তু ভালো দিনও আসবেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.