চারদিক-শতবর্ষ পেরিয়ে রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি by হাসান ইমাম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনো পাননি নোবেল পুরস্কার। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে তখনো চলছে জোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোলধ্বনিতে তখনই মুখর হয়ে ওঠে আম-কাঁঠাল আর হিজল-তমালের বনে ঢাকা লোহাগড়া গ্রামটি।


প্রেসিডেন্সি বিভাগের জেলা শহর যশোর থেকে ৩০ মাইল পূর্বে (বর্তমানে নড়াইল জেলার অন্তর্গত লোহাগড়া উপজেলা) ঢেউ খেলানো মধুমতী আর নবগঙ্গার উর্বর পলিতে গঠিত লোহাগড়া জনপদ। ১৯০৭ সাল। সেই সময়ে লোহাগড়ার মতো একটি স্থানে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সত্যিই বিস্ময়কর একটি ব্যাপার।
লোহাগড়ায় তখন তিন ঘর জমিদার—রায়, মজুমদার ও সরকার। শিক্ষা ও সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই ছিল এই তিন গোষ্ঠীর প্রতিযোগিতামূলক পদচারণ। এর মধ্যে মজুমদার বংশের আইনজীবী রায় বাহাদুর জদুনাথ মজুমদার ছিলেন লাহোর ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য। অন্যদিকে সরকার বংশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ড. মহেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন কলকাতা সরকারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। রামনারায়ণ সরকার ছিলেন এই বংশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ইতিমধ্যে ড. মহেন্দ্রনাথ সরকার জদুনাথ মজুমদারের মেয়েকে বিবাহ করেন। আর এর মাধ্যমে দুই বংশের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিত্রতায় রূপ নেয়। এ সময়ে জ্ঞানতাপস ড. মহেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় দুই বংশের দুটি পারিবারিক পাঠাগারকে একত্র করে গড়ে তোলা হয় এবং নাম দেওয়া হয় ‘শ্রীকৃষ্ণ লাইব্রেরি’। এই লাইব্রেরির মাধ্যমেই লোহাগড়ার শিক্ষিত সাধারণ মানুষ বইয়ের ছোঁয়ায় পুলকিত হয়। এর প্রায় এক যুগ পর রামনারায়ণ সরকারের ছেলে ভুবন মোহন সরকার লাইব্রেরির জন্য একটি দ্বিতল ভবন তৈরি করে দেন। আর সেখানে বাবার স্মৃতিকে ধরে রাখার মানসে এর নামকরণ করেন ‘রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি’। ১৯২১ সালে এই লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। তখন থেকেই রাখা হতো দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক সংবাদপত্র। শুধু কি বই পড়া? চালু করা হয় সমাজকল্যাণ বিভাগ। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে সেলাই শেখানো, যুবকদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উৎসাহিত করা হতো; যা আজও অব্যাহতভাবে চলছে।
১৯৪০ সালে এই লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজারে। ‘জন্ম হতে এ পর্যন্ত লাইব্রেরির উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয় বহুলাংশে নির্বাহ হয়েছে ধনীদের ব্যক্তিগত দানে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালের দিকে কিছুসংখ্যক মহৎ ব্যক্তির আগ্রহে লাইব্রেরিটা তার জীর্ণাবস্থা থেকে উঠে আসে বর্তমান স্থানে; যা আর এক শতবর্ষী লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সম্মুখে অবস্থিত।’—এভাবেই তাঁর পুরোনো স্মৃতি মন্থন করেন লাইব্রেরির সঙ্গে মিশে থাকা বর্তমানে সবচেয়ে প্রবীণ লোকটি আবদুল মালেক বিশ্বাস। বর্তমান দ্বিতল ভবনটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিত্তবানদের সহায়তা ছাড়াও জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে অগ্রিম ভাড়ার টাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়। নিচতলা জনতা ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়া। দ্বিতীয় তলায় চলে লাইব্রেরির কার্যক্রম; যার এক কক্ষে বই রাখা, এখানেই চলে বই নেওয়া ও দেওয়ার কাজ। দ্বিতীয় কক্ষের সাজানো-গোছানো স্থানেই বসে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট সংসদ, আর অধিক প্রশস্ত কক্ষটিতে চলে পাঠ। বিকেল চারটা বাজতেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় লাইব্রেরি। রাত আটটা পর্যন্ত চলে শুধু বইয়ের পাতার খসখস শব্দ। কথা হয় লাইব্রেরির একজন নিয়মিত পাঠক কলেজশিক্ষক শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। শুরু ১৯৮৩ সালের দিকে। আজ অবধি চলছে। সময় পেলেই চলে আসেন বইয়ের সঙ্গে সেতুবন্ধে। শরৎচন্দ্রের বই পড়ছেন রেশমী জামান; তিনি বললেন, ‘পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে এখানে আসতাম। আর এখন আমার সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে আসি।’ মন খারাপ হলেই আর দশজন ছেলের মতো খারাপ কাজ না করে সোজা ছুটে আসেন হিফজু, রাজীবুল ও হুসাইন কবির। বইয়ের মাঝে ডুব দিয়ে ভুলে যান সব কষ্ট। আর একজন সিরিয়াস পাঠক সুবিনা আক্তার তাই তো বিকেলে সংসারের সব কাজ ফেলেই ছুটে আসেন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সোহাগ চশমা পরা বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে বলেন, ‘অনেক ভালো লাগে যে আমাদের এই রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি দেশের মধ্যে প্রাচীন ও মানসম্মত গ্রন্থাগার হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে।’ লাইব্রেরির বর্তমান সভাপতি অরুণ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বর্তমানে সব মিলিয়ে এখানে বইয়ের সংখ্যা ১১ হাজারের মতো। তা ছাড়া বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গেজেট, ক্যালকাটা রিভিউ-এর মতো পুরোনো সম্পদ ছাড়াও আছে দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা যেমন—বসুমতী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ধূমকেতু ইত্যাদি। এ ছাড়া তুলট কাগজে লেখা পুঁথি, যা বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজনে যশোর পাবলিক লাইব্রেরিতে আছে।’
উপজেলার মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে বর্তমান কার্যনির্বাহী পর্ষদ কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান লাইব্রেরির সম্পাদক সৈয়দ আকরাম আলী। সহকারী সম্পাদক আনিসুর রহমান বলেন, ‘তরুণ ছাত্রদের লাইব্রেরিমুখী করতে এখানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা-সহায়ক গ্রন্থ রাখা হবে শিগগিরই। ইন্টারনেট চালুরও ইচ্ছা আছে।’ লাইব্রেরির সমাজকল্যাণ বিভাগ পরিচালিত হয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতায়। কোনো ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী অথবা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা বিদেশি বিদ্যোৎসাহী লোহাগড়ায় এলে একবার অবশ্যই দুর্নিবার আকর্ষণে ঢোকেন শত বছরের পুরোনো এই রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরিতে। আর পড়ে যান সেই চিরচেনা লাইনটি, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন—বই, বই এবং বই’। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ পড়ে সেই বিদ্যানুরাগী লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা ড. মহেন্দ্রনাথ সরকারের চোখে; যে চোখ প্রশ্ন করছে, ‘আপনি কি আজ বই পড়েছেন?’

No comments

Powered by Blogger.