ঘাটতি অর্থায়নে বড় ভরসা ব্যাংকঋণ

বৈদেশিক সহায়তা আবারও খুব বেশি পাওয়া যাবে না—এ কথা মেনে নিয়েই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের ওপর নির্ভর করে বড় আকারের ঘাটতি বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনটি অর্থবছর পর বাজেট ঘাটতি আবার ৫ শতাংশ অতিক্রম করল বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে। সরকারের প্রাক্কলন ৫ দশমিক ১ শতাংশ।


এ রকম একটি অতীত নিয়ে নতুন অর্থবছরেও ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি হবে বলে প্রাক্কলন করলেন অর্থমন্ত্রী। আর এই ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে সরকারকেই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি হারে ঋণ নিতে হবে।
নতুন ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই বাজেট মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেট জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ থাকলেও সংশোধন করায় তা হয়েছে জিডিপির ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন বাজেটে সব মিলিয়ে অনুন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ এক লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। আর মোট ব্যয়ের মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশাল এই ব্যয় পরিকল্পনার বিপরীতে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কাটি টাকা। এই পরিমাণ আয় জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বাইরে এনবিআরবহির্ভূত করের পরিমাণ চার হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা (জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ) এবং করবহির্ভূত রাজস্ব ২২ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ।
আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতায় আগামী অর্থবছরে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা ৫ শতাংশ। তবে অনুদান বাদ দিলে ঘাটতি হবে ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটানোর একটি পরিকল্পনাও অর্থমন্ত্রীকে দিতে হয়েছে। মূলত ১২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ এবং ৩৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে সর্বোচ্চ ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে পাওয়া যাবে সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতির ১ দশমিক ৮ শতাংশ আসবে বৈদেশিক উৎস থেকে এবং ৩ দশমিক ২ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।
বিদায়ী অর্থবছরে ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে হচ্ছে ২৯ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে পাওয়ার কথা ছিল ছয় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকার পাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার আশা থাকলেও সরকার শেষ পর্যন্ত পাবে বলে মনে করছে ১৪ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এ কারণে সরকারের পুরো বাজেট পরিকল্পনাই এলোমেলো হয়েছিল। ফলে চাপ পড়েছে সার্বিক অর্থনীতির ওপর।
নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ আসবে পরোক্ষ কর খাত থেকে, যার বেশির ভাগই দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। যেমন, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আসবে ৪০ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা, যা মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানি শুল্ক থেকে ১৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, আয়কর থেকে ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সম্পূরক শুল্ক খাতে ১৯ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ রাজস্ব আসবে।
৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়ের বাইরে অনুন্নয়ন বা রাজস্ব ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ যাবে সুদ পরিশোধে। এ খাতে ব্যয় হবে মোট রাজস্ব ব্যয়ের ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হবে ১৭ শতাংশ এবং ভর্তুকি খাতে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এত দিন বেতন-ভাতা ছিল অনুন্নয়ন ব্যয়ের বড় খাত। এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে সুদ পরিশোধ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়ে যাওয়ায় সুদ পরিশোধ প্রথম স্থান অধিকার করল। নতুন অর্থবছরেও বড় আকারের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। ফলে এবারও সুদ পরিশোধ এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.