পিপিপির জন্য আবারও তিন হাজার কোটি টাকা by ফখরুল ইসলাম

আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) জন্য আবারও তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে জাতীয় বাজেটে চতুর্থবারের মতো পিপিপি বাবদ অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলো।


এবারসহ পিপিপিতে তিন বছর ধরেই তিন হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ রেখে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমবার ২০০৯-১০ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। প্রথমবার পিপিপির জন্য আলাদা একটি অবস্থানপত্র উপস্থাপন করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর নাম দিয়েছিলেন ‘নব উদ্যোগ বিনিয়োগ প্রয়াস’। যদিও কোনো কাজে আসেনি এই প্রয়াস। অর্থাৎ কোনো বছরই এই খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি।
আগামী অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যের ‘অবকাঠামো খাতে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ’ অংশে পিপিপি নিয়ে যত কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে তিন বছরের উপর্যুপরি ব্যর্থতার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি। শুধু বলেন, ‘আশানুরূপ না হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পিপিপি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। আমি আশা করি, অচিরেই এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করা যাবে।’
অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণে পিপিপির আওতায় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন বলে এবারের বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পিপিপি কাঠামো স্বচ্ছ, শক্তিশালী করা এবং এতে সরকারি অংশীদারি নিশ্চিত করতে পিপিপি অফিসকে স্বতন্ত্র অফিস হিসেবে গড়ে তুলেছি। এই অফিস আর্থিক ও নির্বাহী ক্ষমতার দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করছে।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, অর্থ বিভাগে পূর্ণাঙ্গ পিপিপি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। পিপিপি বিষয়ে এ মাসের মধ্যেই তারা একটি ম্যানুয়েল উপহার দেবে। অকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়ার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছি পিপিপির ভিত্তিতে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত করার কৌশল হিসেবে অবকাঠামো খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী কিছু না বললেও পিপিপি অফিস সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকার ভাগ হবে তিনভাবে। দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ অবকাঠামো অর্থায়ন তহবিল (বিআইএফএফ), ৪০০ কোটি টাকা বাণিজ্যিকভাবে আপাতত অলাভজনক কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পিপিপি প্রকল্পগুলোতে ‘ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং-ভিজিএফ’ হিসেবে এবং ১০০ কোটি টাকা পিপিপি প্রকল্পের কারিগরি সহায়তার জন্য।
চলতি অর্থবছরে পিপিপির আওতায় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ রাখা হলেও সরকারের নিজেরই প্রস্তুতির অভাবে সেটি হয়নি। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ অবকাঠামো অর্থায়ন তহবিল লিমিটেড (বিআইএফএফএল) বন্ড ছাড়বে, আর তাতে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে। বিআইএফএফএল সেই বন্ড ছাড়তে পারেনি। তবে আগামী অর্থবছরে তা ছাড়বে বলে জানা গেছে।
গতকালের বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী পরীক্ষামূলক আটটি বড় প্রকল্প ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। প্রকল্পগুলোর নাম উল্লেখ করেননি তিনি। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) আরও ১০টি পিপিপি প্রকল্প থাকবে।
যেহেতু খরচ হয় না, পিপিপি বাবদ বরাদ্দ করা অর্থ তাহলে কোথায় যায়—গতকালের বাজেট বক্তব্যে মানুষের এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আবদুল মুহিত বলেছেন, পিপিপির জন্য বরাদ্দ রাখা অর্থ ভর্তুকি খাতে ব্যয় করা হয়েছে।
পিপিপি হচ্ছে এমন এক দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারি ব্যবস্থা, যেখানে জনগণকে সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করে থাকে। এতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের চুক্তি হয় বা বেসরকারি খাতকে সেবা তৈরির জন্য সরকার নিবন্ধন দিয়ে থাকে।
পিপিপির উদ্যোগে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওওটি); নির্মাণ, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওটি) এবং নির্মাণ, মালিকানা ও পরিচালনা (বিওও)—এই তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।
আগের তিন বছরে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য: ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে এ জন্য দরকার অতিরিক্ত এক লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। পিপিপির উদ্যোগে এই বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করা হবে।’
পরেরবার ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি খাতের সম্পৃক্ততায় ব্যাপক গতি পাবে পিপিপি। দেশি, বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের অংশগ্রহণে গঠিত এই তহবিল ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো প্রকল্পের বিপুল অর্থায়নের চাহিদা মেটাবে।’
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পিপিপি আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন ধারণা এবং অবকাঠামো খাতে পিপিপি চুক্তিগুলো সাধারণত বেশ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। এ জন্য সফলভাবে পিপিপি বাস্তবায়ন করতে হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।’
বক্তব্য ও মতামত: পিপিপি কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাইফউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আটটি ছাড়া বড় আকারের আরও কয়েকটি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। আশা করছি, আগামীতে সবগুলোরই সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পিপিপি ইউনিটের প্রধান ফারুক হোসেন বলেন, ‘পিপিপি নিয়ে একটু বিভ্রান্তি রয়েছে। জানা উচিত যে, হঠাৎ করেই কিছু করা যায় না। তবে এখন পিপিপি আইনি কাঠামোর মধ্যে এসেছে। আগামীতে ভালো কিছু হবে বলেই আমরা ধরে নিতে পারি।’
‘বিশ্ব প্রতিযোগিতার সক্ষমতা প্রতিবেদন (জিসিআর) ২০১০-২০১১’-এর উদাহরণ টেনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন ১০টি দেশের একটি। তবে যথা পদক্ষেপ নিতে পারলে এই সমস্যা নিরসনে পিপিপির উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

No comments

Powered by Blogger.