প্রকৃতি-সামাজিক বনায়ন না বিদেশি আগ্রাসন by জাকিয়া সুলতানা

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন সংরক্ষণে নিয়োজিত বন বিভাগ সামাজিক বনায়নকে সাধারণ মানুষের কাছে বন হিসেবে পরিচিত করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রাকৃতিক বন রক্ষায় এ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ না নিলেও প্রাকৃতিক বন পরিষ্কার করে সামাজিক বনায়নের নামে আগ্রাসী অথবা বিদেশি অথচ একই প্রজাতির একাশিয়া,


মেহগনি, টিক রোপণ করছে এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছে কলা, আনারস, শিম, তামাক, পেঁপে ইত্যাদি। ফলে সামাজিক বনায়নের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক বন। অথচ কোনো দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বন থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ হার মোট ভূমির ৬.৮ শতাংশ আর ফরেস্ট্রি সেক্টর মাস্টার প্ল্যান ১৯৯৩-২০১২-এর তথ্য মতে, দেশে বন ধ্বংসের হার শতকরা ৩ শতাংশ। এরূপ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন প্রাকৃতিক বন বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না এ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে। আর যদি বনই না থাকে, তবে কী সেবা আমরা আশা করছি বন থেকে। প্রাকৃতিক বন থেকে আমরা যে সেবা পেতে পারি সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট বন-বাগানের মাধ্যমে তা পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়, কেননা সামাজিক বনায়নের সৃষ্ট বন-বাগানের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে এবং মেয়াদ শেষে তা কেটে ফেলা হয়। আবার বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোড়ন ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রাকৃতিক বনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সামাজিক বনায়ন নয়। গবেষকদের মতে, একটি বৃক্ষ যখন কেটে ফেলা হয় তখন বৃক্ষটি সারা জীবনে যে পরিমাণ কার্বন ধরে রাখে তার সবটুকু সে একবারেই ছেড়ে দেয়। ফলে প্রকৃতিতে কার্বনের পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বনে রয়েছে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ঘাস, বাঁশ ইত্যাদির সমারোহ, যার প্রতিটি উপাদানই আপনাআপনি সৃষ্টি এবং পুনর্জন্ম হয় বলে কখনও নিঃশেষ হয় না এবং অধিক কার্বন ধরে রাখতে পারে। প্রকৃতিবিদদের মতে, যে গাছ যেখানে আপনাআপনি জন্মায় তা সেখানকার জন্যই বিশেষ উপযোগী। সুতরাং প্রাকৃতিক বন আমাদের দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য কতটা উপযোগী তা বলাই বাহুল্য। অথচ বন আইনে দু'বার সংশোধনী আনা হলেও পরিবেশ উপযোগী এ প্রাকৃতিক বন রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং বন ধ্বংসের হারকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সামাজিক বনায়ন কর্মকাণ্ডকে আইনগত বৈধতা প্রদান করেছে। ২০১০ সালের প্রস্তাবিত বন আইনের সংশোধনীও প্রাকৃতিক বন রক্ষায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। প্র্রস্তাবিত এ সংশোধনীতে বনের সংজ্ঞায় বৃক্ষাচ্ছাদন, জীববৈচিত্র্যের সম্ভার ইত্যাদিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে সরকার ও বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাকে বন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ জাতীয় সংজ্ঞা বন সংরক্ষণের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। বন ব্যবস্থাপনায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার নামে বন বিভাগ বিভিন্ন সময় নতুন কিছু কর্মসূচি যেমন_ সামাজিক বনায়নের মতো প্রস্তাবিত সংশোধনীতেও যৌথ বন ব্যবস্থাপনা নামক নতুন ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবনা রেখেছে, যেখানে ব্যবস্থাপনার রূপরেখা স্পষ্ট করেনি বা এরূপ ব্যবস্থাপনায় বনবাসী বা বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার ও ক্ষমতা স্পষ্ট করেনি। তাই কোনোভাবেই এ বন ব্যবস্থাপনায় বনবাসী বা বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক বন রক্ষা করতে পারে না। তবে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত বন আইনের উদ্দেশ্য রাজস্ব আদায় করা হলেও এ আইনের একটি বিশেষ বিধানের বাস্তবায়ন প্রাকৃতিক বন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বন আইন, ১৯২৭-এর ধারা ২৮ অনুযায়ী সরকার যে কোনো রিজার্ভ বনে তার অধিকার যে কোনো গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ওপর ন্যস্ত করতে পারে। আর এ ধরনের ন্যস্তকৃত বন গ্রামবন হিসেবে পরিচিত হবে। গ্রামবন ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার বিধি প্রণয়ন করতে পারে। বিধিতে বন রক্ষা এবং উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কর্তব্যও বিধিতে নির্ধারণ থাকবে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সরকার বন রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণের কথা বললেও অদ্যাবধি ধারা ২৮-এর অধীনে কোনো বিধি প্রণয়ন করেনি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বন ব্যবস্থাপনার কিছু দৃষ্টান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, সরকারের ক্ষমতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করে 'গ্রাম বন ব্যবস্থাপনা'র উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই শুধু আমাদের এ প্রাকৃতিক বন রক্ষা করা সম্ভব। ১৯৮০ সালের শেষ দিকে নেপালে বন উজাড়ের হার ছিল ১০.৭ শতাংশ এবং আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, ১৯৯৫ সালের মধ্যে নেপালে বনশূন্য হয়ে পড়বে। বন উজাড় রোধকল্পে নেপাল সরকার কর্তৃক প্রণীত বন আইন, ১৯৯৩ এবং বন রেগুলেশন, ১৯৯৫-এ বিধান করা হয় যে গ্রামীণ সম্প্রদায় কর্তৃক ব্যবস্থাপনার উপযোগী সব বন কেবল কমিউনিটি বন হিসেবে ব্যবস্থাপনা করা হবে। নেপালে কমিউনিটি বন ব্যবস্থাপনা এতটাই সফল হয়েছে যে, বর্তমানে বনের পরিমাণ মোট বনভূমির ২৯ শতাংশ এবং নেপাল সরকার মোট বনভূমির ৬১ শতাংশ এ ধরনের ব্যবস্থাপনার অধীনে আনার চিন্তা করছে। ভারতেও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে কমিউনিটি বন ব্যবস্থাপনা কার্যকরী মডেল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিস্তৃত বনাঞ্চল রক্ষায় কমিউনিটি বন ব্যবস্থাপনার অধীনে ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশে গ্রামবাসী গঠন করেছে জঙ্গল সুরক্ষা মহাসংঘ। বন রক্ষা কর, কাঠ নয়_ এ মন্ত্রে উজ্জীবিত গ্রামবাসী বনে কোনো গাছ লাগায় না, অস্ত্র হাতে বনে প্রবেশ করে না এবং কাঠের প্রয়োজন হলেও শুকনো ডাল-পাতা সংগ্রহ করে। এসব নিয়ম পালন করে মাত্র ৫-৬ বছরে ফিরিয়ে এনেছে উড়িষ্যার কমিউনিটি বন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত জনসাধারণ। ঠিক একই বিশ্বাস বিরাজ করছে আমাদের দেশে বসবাসরত বনবাসীদের মধ্যে। তারা করাত নিয়ে বনে প্রবেশ করে না, কেননা বনবিবি রুষ্ট হয় এবং পাতা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মাইজপাতা (নতুনপাতা) এবং ঠেসপাতা (পরিপকস্ফ পাতা) রেখে দেয়। একই ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হচ্ছে গ্রামবন ব্যবস্থাপনা চালু না করার মধ্য দিয়ে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের চরম হুমকির মুখে থাকা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রাকৃতিক বন রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গ্রামবন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন অধিকার প্রতিষ্ঠা করে প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ ও ক্ষেত্রবিশেষে বন ফিরিয়ে আনাই বর্তমান সময়ের দাবি।

জাকিয়া সুলতানা : আইনজীবী, বেলা
 

No comments

Powered by Blogger.