অনুসন্ধান-মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দূতাবাস by নুরুল ইসলাম বিএসসি

সৌদি আরবে কর্মরত ২৫ লাখ বাংলাদেশির সমস্যার অন্ত নেই। কাজ পাওয়ার কথা বাদ দিলাম, আকামা পরিবর্তন করা যায় না। আমাদের কর্মসংস্থানমন্ত্রী যতই দাবি করুন সৌদিতে শ্রমিক পাঠাতে কোনো সমস্যা নেই, বাস্তবতা ভিন্ন। যেখানে ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান এমনকি নেপালিরা যেতে পারছে, বাংলাদেশিদের কোনো ভিসাই দেওয়া হচ্ছে না।


আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ করেছেন, তাদের সবার অভিযোগ দূতাবাসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যারা বর্তমানে সৌদি বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত আছেন, বিশেষ করে ভাইস কনসাল জেনারেল, তাদের দাবি, একসময় তিনি বরিশালে জামায়াতের রোকন ছিলেন। সরকারি পদবি ব্যবহার করে, সরকারি বেতন নিয়ে তিনি জামায়াতের কাজ করছেন। মীর কাসেম আলী যখন সৌদি আরবে ছিলেন, তার সঙ্গে ওঠাবসা ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সমাবেশের আয়োজন তিনি করে দিয়েছেন বলে বাংলাদেশিদের দাবি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে খবর আছে কি-না জানা নেই, তবে এ বিষয়ে পূর্ণ তদন্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডিজির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগের শেষ নেই। এই ব্যক্তি নাকি একসময় চট্টগ্রাম মুহসীন কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রশিবিরের ক্যাডার ছিলেন। ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজনকে দুর্বল করার যত কৌশল আছে তিনি সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় তা করেছেন। তিনি নাকি মহিউদ্দীন, জসীম উদ্দিন ও মুজিবর রহমানকে সৌদি থেকে বহিষ্কারে পর্দার অন্তরালে থেকে ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ছেলেগুলো আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল। এই ব্যক্তিকে উচ্চপদে বসিয়ে বিদেশের মাটিতে জামায়াতের কর্মকাণ্ড দমন কী করে সম্ভব, মন্ত্রণালয়ের বোঝার কথা।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মিসর, দুবাইয়ে কর্মরত দূতাবাস প্রধানসহ সকল স্তরের জামায়াত-শিবিরের কর্মচারীদের দেশে তলব করা দরকার এবং আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। দূতাবাসের সকল স্তরের কর্মচারী চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাদের বেশিরভাগ জামায়াতি। এরাই বর্তমানে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য নানা কল্পকাহিনী প্রচার করে বেড়াচ্ছে। ডা. আনিস নামের একজন প্রকাশ্যে বলে বেড়ান, এই সরকার মসজিদে বিদ্যুৎ না দিয়ে মন্দিরে বিদ্যুৎ দেয়। পৌত্তলিকতায় উৎসাহ দেয়। যেহেতু দূতাবাসের লোকজন এগুলো প্রচার করে, সরকারি মুখপাত্র হিসেবে এদের কথাই ওই দেশের সরকার বিশ্বাস করে। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আমাদের শ্রমবাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। পাকিস্তানি ও ভারতীয় শ্রমিকরা যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে, জামায়াতিদের অপপ্রচারে আমাদের শ্রমিকদের মাথা নিচু করে বসবাস করতে হয়। আল্লাহই জানেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে কি-না।
মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত কিছু অর্ধশিক্ষিত অথবা একেবারেই অশিক্ষিত ধনী ব্যবসায়ী প্রতিমাসে বিরাট অঙ্কের টাকা জামায়াতের ফান্ডে ডোনেশন হিসেবে পাঠান। তাদের বোঝানো হয়েছে, জামায়াত আল্লাহর দল, জামায়াতকে সাহায্য করা মানেই বেহেশতের রাস্তা পরিষ্কার করা। জামায়াত যে মিথ্যা প্রচার করে এটা বিশ্বাস করতে তারা নারাজ। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। জামায়াতের প্রকৃত চেহারা তাদের কাছে পরিষ্কার করলেই অজ্ঞতার নিরসন হবে। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে বসবাসের সুবাদে সৌদি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ ও পরিচয়। ইসলাম রক্ষার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা এরা আদায় করে। আদায়কৃত টাকার কিছু অংশ এরা নিজেরা মারে, বাকি টাকা জামায়াতের তহবিলে পাঠিয়ে বেহেশতের রাস্তা সুগম করে। যাদের হাত ঘুরে কোটি কোটি টাকা জামায়াতের ফান্ডে ঢোকে, তাদের নামের তালিকা আমার কাছে আছে; পরবর্তী সময়ে তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করার ইচ্ছা রইল। এখানে নেয়ামত উল্লাহ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মস্তবড় ডোনার। এই ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে সৌদিতে বসবাস করার সুবাদে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। জামায়াত তাদেরই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। শুধু জামায়াতের কথা বলি কেন? আমাদের অনেক নেতা আছেন, সৌদিতে গেলে তাদের ঘরে খাবার খান, থাকেন ও হাদিয়া গ্রহণ করেন। এমনও শোনা যায়, দেশে বসেও অনেক নেতা তাদের কাছ থেকে ডোনেশন পান।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময়ক্ষেপণ না করে তাদের ডোনেশনের পথ বন্ধ না করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। যারা ডোনেশন দেন তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ভালো কাজে ডোনেশন দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চরম অবস্থায় তাদের পাসপোর্ট বাতিল করার বিকল্প নেই।
সৌদি দূতাবাসে কমার্শিয়াল কনস্যুলেট থাকার কথা। বাংলাদেশি পণ্যের প্রসারে তারা কোনো অবদান রেখেছে বলে নজির নেই। এ জামায়াতি কর্মচারী-কর্মকর্তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। অথচ চেষ্টা করলে বাংলাদেশি ওষুধ, কার্পেট, টুপি, ব্যাগ, লুঙ্গিসহ অনেক পণ্যের বাজার সৃষ্টি হতে পারে।
দূতাবাসের কর্মচারীরা জামায়াতের কাজ করতে ব্যস্ত, দেশের কাজ করবেন কখন? এ যেন সরকারি টাকায় জামায়াত নামক দলকে লালনপালন করার শামিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর কতদিন চোখ বন্ধ করে ঘুমাবে?
জামায়াতিরা বিদেশের মাটিতে এই সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রচার সেল গঠন করে অপপ্রচার চালাচ্ছে, আমাদেরও পাল্টা সেল গঠন করতে হবে অথবা দূতাবাসগুলোর প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজনকে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।
জেদ্দায় বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটিও জামায়াতিদের প্রচার ও প্রসারের আখড়া। কর্মরত অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম ফারুকের বায়োডাটায় আফাজউদ্দিন মহিলা ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে ৩০.২.২০১০ তারিখ দেখানো হয়েছে। এটা যোগ্যতা হলে জামায়াত করার সুবাদে নিয়োগপ্রাপ্ত। এই স্কুলের কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশিরভাগ জামায়াতের লোক। স্কুল পরিচালনা কমিটির প্রধানও জামায়াতি। অধ্যক্ষকে সহসা বহিষ্কার না করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে বাধ্য। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে ভেবে দেখতে পারেন।
আমি আগেই বলেছি, সৌদি আরবে বসবাসরত কিছু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ব্যবসায়ী বেহেশতের দরজা নিরাপদ করার অপপ্রচারে বিশ্বাস করে জামায়াতকে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দেন। অপরদিকে, এমন শ্রমিক আছেন যারা রাতদিন পরিশ্রম করে জীবনের দিশা খুঁজতে ব্যস্ত। তাদের সমস্যার অন্ত নেই। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যারা ওই দেশের আইন হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করে না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে দেখা যায়, এরা সবাই বাংলাদেশি। সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের বদনাম হয়, সবার জন্য বিপদ নেমে আসে। প্রকৃত ঘটনা হলো, এরা বাংলাদেশি নয়, সবাই মিয়ানমারের লোক, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী।
পাসপোর্টগুলো রিয়াদ বা জেদ্দায় দূতাবাসগুলো থেকে ইস্যুকৃত। সবচেয়ে বেশি পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে চারদলীয় জোট আমলে। দূতাবাসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা দশ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে এই পাসপোর্টগুলো মিয়ানমারের নাগরিকদের ইস্যু করেছেন। উখিয়া, টেকনাফ, কক্সজারের বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব সনদ প্রদান করেন এবং থানার কর্মচারীরা ভেরিফাই করে দেয়। এমন ঘটনা ঘটেছে, সবকিছুই জাল। ওই জাল বা ভুয়া সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে জেনেশুনে দূতাবাস পাসপোর্ট ইস্যু করে দেশের জন্য সংকট তৈরি করে। সার্ভে চালালে কত হাজার পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে সব বেরিয়ে আসবে। পাসপোর্টগুলো যতদিন এদের হাতে থাকবে, বাংলাদেশিরা সৌদি আরবে নিরাপদ থাকবে না।

নুরুল ইসলাম বিএসসি : সংসদ সদস্য
 

No comments

Powered by Blogger.