বাঘা তেঁতুল-খালাতো ভাই ও জেলাতো ভাই by সৈয়দ আবুল মকসুদ

আদম ও হাওয়া-পরবর্তী চার প্রজন্ম থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কারও না কারও খালাতো ভাই বা বোন। কারও মায়ের যদি কোনো বোন না থেকে থাকে কিংবা যদি কারও খালা চিরকুমারী হয় অথবা নিঃসন্তান হয়ে থাকে, তার কারও খালাতো ভাই হওয়ার সৌভাগ্য হবে না।


তবে খালাতো ভাই থাক বা না-থাক, প্রত্যেকে কারও না কারও চাচাতো, মামাতো বা ফুফাতো ভাই বা বোন।
মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণের পর কালবিলম্ব না করে ডাক বিভাগ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যাঁরা নিহত হন, তাঁদের স্মরণে ১৭টি ডাকটিকিট অবমুক্ত করে। তিন টাকা মূল্যমানের একটি টিকিটের ওপর লেখা: ‘আব্দুল নঈম খান রিন্টু/আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই/জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৫৭।’ ডাকটিকিট প্রকাশ করা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন অন্যখানে। আজ উল্লাপাড়া বা ভূরুঙ্গামারী বা ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কোনো ব্যক্তি তাঁর লেখা চিঠির খামে আঠা লাগিয়ে যখন টিকিটটি সাঁটতে যাবেন, তিনি বুঝতেই পারবেন না ৫২ বছর আট মাস বয়স্ক এই ব্যক্তির নামে কেন ডাকটিকিট করা হয়েছে। কারণ, টিকিটের কোথাও ১৫ আগস্টের কথা লেখা নেই। তিনি যে মারা গেছেন, সে কথাও কোথাও বলা নেই।
যাঁর সম্মানে বা স্মরণে ডাকটিকিট, তিনি যাঁর খালাতো ভাই, তাঁকে কোনোক্রমেই দোষ দেওয়া যাবে না। টিকিটটি তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়নি। তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীও নন। ভাগ্যচক্রে প্রবীণ নেতা হওয়া সত্ত্বেও এই সরকারে তাঁর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও নেই। বিষয়টি তাঁকে বরং বিব্রত করল।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন দুই শ্রেণীর মানুষ: রাজনীতিক ও আমলা। রাজনীতিক বা জননেতাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অপরিহার্য নয়। জনগণের আবেগ-অনুভূতি উপলব্ধি করার যোগ্যতা তাঁদের থাকলেই হলো এবং আমলাদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকা চাই। তা না থাকলে আমলারা জননেতাদের মাথায় কাঁঠাল রেখে দিব্যি কোয়াগুলো খুলে খেতে থাকবেন। শুধু নিজেই যে খাবেন তা-ই নয়, খালাতো ভাইকেও দু-এক কোয়া খাওয়াবেন এবং শ্যালিকার মহা বাখোয়াজ স্বামীর মুখেও দু-একটা পুরবেন।
রাষ্ট্রের আমলাদের প্রাথমিক যোগ্যতা সুশিক্ষিত হওয়া। রাজনৈতিক নেতারা সীমিত সময়ের জন্য আসেন, আমলারা রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্তা। তাঁদের কেউ কেউ যদি সামান্য দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ঢাকায় দুটি বাড়ি ও গোটা পাঁচেক ফ্ল্যাট স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কেনেন, তো আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু প্রশাসন চালানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা ও দক্ষতা থাকতেই হবে। আমলাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও কর্তব্যবিমুখতা ক্ষমার অযোগ্য। তাঁদের বেতন-ভাতাটা জনগণ দেয়—আকাশ থেকে পড়ে না।
ডাকটিকিটের এই কাণ্ডটি স্বাধীনতার আগে হলে, বিশেষ করে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে হলে ডাক বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা দায়ী, তাঁরা সাময়িক বরখাস্ত হতেন। স্বাধীন দেশে সেটা বড়ই নির্মম মনে হবে। এখন অন্তত কৈফিয়তটা তো তলব করা যায়।
অবশ্য কৈফিয়ত তলব করেও কিছু হবে না। এখন যেকোনো অপকর্ম করে রেহাই পাওয়ার একটি মোক্ষম উপায় পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত টেবিলে চাপড় মেরে বলবেন: ‘এ কাজ করেছে বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো লোক। আমাদের মতো বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা এ কাজ করতেই পারেন না। ব্যস। তাঁর সাত খুন মাফ। উপায় আরও একটি আছে। বছরখানেকের মধ্যে যদি ডাক বিভাগের কোনো বড় কর্মকর্তা মারা গিয়ে থাকেন, দোষটা স্রেফ তাঁর ঘাড়েই চাপানো হবে। কারণ, ওপার থেকে এসে আত্মপক্ষ সমর্থন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন আমাদের চোখে যে স্বপ্নই থাকুক, দেশ স্বাধীন হয়েছিল আগের চেয়ে আরও উন্নত রাষ্ট্র গঠনের জন্য নয়; দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নতি ঘটানোর জন্য তো নয়ই। ফাঁকতালে কিছু লোক জনগণের মাথার ওপরে বসে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য। তাঁদের জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। অযোগ্যতা ও অপকর্মের জন্য তাঁদের শাস্তি পাওয়ার ভয় নেই। তাঁরাই স্বাধীন। তাই ৩৮ বছর বয়স্ক কর্মকর্তাও পোডিয়ামে পদাঘাত করে বলছেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এক বছরের বেশি এই পদে আছি। এবার প্রমোশন না দিলে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ কইরা ছাড়ুম।’ পদোন্নতি তিনি নির্ঘাত পান। যোগ্যতা আট নম্বর গ্রেডের, গলায় গামছা দিয়ে প্রমোশন আদায় করে চলে যান এক নম্বর গ্রেডে।
অথচ দেশে যোগ্য মানুষ প্রচুর আছেন। আছেন বলেই বেসরকারি সেক্টর হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও শুধু টিকেই আছে তা-ই নয়, যথেষ্ট ভালো করছে। অন্যদিকে প্রতিটি সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ছে। তাই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও সরকারি চিকিৎসকেরা ঢাকার বাইরে কর্মস্থলে যাচ্ছেন না। কৈফিয়ত চাইলে বলবেন: ‘একুশ বছর জয় বঙ্গবন্ধু বলায় সাফার করেছি। পল্লিবিদ্যুতের যে অবস্থা, উপজেলায় ২২ ঘণ্টা কারেন্ট থাকে না। আমার ওয়াইফ গরম সহ্য করতে পারে না। পাঁচ মিনিট ফ্যান ছাড়া তার চলে না।’
এ মাসে অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, রাস্তাঘাটে ব্যানার-তোরণ দেখে মনে হয়েছে, ৯৯ ভাগ মানুষই বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী। তাঁদের যেন কোনো অতীত নেই। অন্যদিকে প্রশাসন ও গোটা দেশ ভরে গেছে নেতা ও সাংসদদের খালাতো ভাইয়ে। শুধু খালাতো ভাই নয়, জেলাতো ভাইয়ের সংখ্যা আরও বেশি। সুতরাং অদক্ষ ও কর্তব্যবিমুখতার জন্য তাঁদের একটি চুলও স্পর্শ করতে পারবে না কেউ, আগামী সাড়ে তিন বছর। খালাতো-জেলাতো ভাইবোনেরাই বাস্তবায়ন করবেন রূপকল্প ২০২১। তবে আমরা যা বুঝি তা হলো: ব্যক্তিজীবনে খালাতো ভাই খুবই মূল্যবান কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে সে সম্পর্ক অর্থহীন শুধু নয়, ক্ষতিকর।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.